সিলভিয়া গ্রুপের হাজার কোটি টাকা ব্যাংক জালিয়াতি, পাচার ২১৫ কোটি টাকা

অর্থনীতি

স্বদেশবাণী ডেস্ক: ঋণ জালিয়াতির দায়ে বহুল আলোচিত চট্টগ্রামের সিলভিয়া গ্রুপ ২১৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা বিদেশে পাচার করেছে। এর মধ্যে জাহাজ আমদানি করে ১৭৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ও অন্যভাবে ৩৯ কোটি টাকা পাচার করা হয়। পাচারের টাকায় সিলভিয়া গ্রুপের কর্ণধার মুজিবুর রহমান মিলন সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাজ্যে গড়ে তুলেছেন ৬টি কোম্পানি।

এসব কোম্পানির নামে সিঙ্গাপুরে ২টি, মাল্টায় ২টি, যুক্তরাজ্যে ১টি এবং ইতালিতে ১টি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। এছাড়া মিলনের নামে সিঙ্গাপুরের ২টি ব্যাংকে ৫টি ব্যক্তিগত হিসাব রয়েছে।

বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বাংলাদেশে ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-বিএফআইইউ) এক তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। সেখানে সিলভিয়া গ্রুপের পাচার করা অর্থের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়।

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ পাচারের ঘটনা উদ্ঘাটিত হওয়ায় পরবর্তী তদন্তের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) প্রতিবেদনটি পাঠানো হয়েছে। কারণ মানি লন্ডারিংয়ের বিধি অনুযায়ী দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের মাধ্যমে পাচার করা অর্থের তদন্ত করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হচ্ছে এনবিআরের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অদিধফতর।

এ প্রসঙ্গে বিএফআইইউর প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান যুগান্তরকে বলেন, বিএফআইইউর কাজ হচ্ছে, পাচারের গোয়েন্দা তথ্য দেশের অন্য তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে সরবরাহ করা। ওই সংস্থাগুলো পাচারের প্রমাণ পেলে দেশের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারে।

তিনি আরও বলেন, পাচার করা টাকা ফেরত আনার প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি হলেও দেশে টাকা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এজন্য আদালতের নির্দেশে জড়িত ব্যক্তির সম্পত্তি জব্দ করতে হবে। পরে আদালতের রায় অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসসংশ্লিষ্ট দেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে পাঠিয়ে সে দেশে আইনি সহায়তা চাইতে পারে। তখন অর্থ ফেরত আনা সম্ভব।

সিলভিয়া গ্রুপ দেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। গ্রুপের অন্যতম কর্ণধার মুজিবুর রহমান মিলন বাংলাদেশের পাশাপাশি সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। তিনি কয়েক বছর আগেই ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পালিয়ে গেছেন। এখন তিনি সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন বলে বিএফআইইউর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সিলভিয়া শিপট্রেড লিমিটেড, অলসিস হোল্ডিং লিমিটেড, ট্যালেন্ট মাইল লিমিটেড, হেড রুবি গ্রুপ লিমিটেড, ওশান ফ্লো হোল্ডিং লিমিটেড নামে ৫টি সিঙ্গাপুরে এবং যুক্তরাজ্যে সিলভিয়া (লন্ডন) নামে ১টি কোম্পানি রয়েছে। বর্তমানে মিলনের নামে সিঙ্গাপুরের ডিবিএস ব্যাংকে ৪টি ও সিটি প্রাইভেট ব্যাংকে ১টি ব্যক্তিগত হিসাব এখন পরিচালিত হচ্ছে।

অলসিস হোল্ডিং ও হেড রুবি গ্রুপ লিমিটেডের নামে সিঙ্গাপুরের ডিবিএইচ ব্যাংকে ১টি করে ২টি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। অলসিস হোল্ডিং ও ট্যালেন্ট মাইল লিমিটেডের নামে মাল্টার আইআইজি ব্যাংক (মাল্টা) লিমিটেডে একটি করে দুটি ব্যাংক হিসাব রয়েছে।

এ হিসাব দুটি ১৩ ফেব্রুয়ারি বন্ধ হয়ে গেছে। হিসাব দুটিতে ২৬ হাজার ৫৫ ইউরো বা ২৬ লাখ ৪১ হাজার টাকা ছিল। সেগুলো যুক্তরাজ্যের এইচএসবিসি ব্যাংকে পরিচালিত সিলভিয়া (লল্ডন) লিমিটেডের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, দেশ থেকে পাচার করা টাকায় তিনি বিদেশে এসব কোম্পানি গড়ে তুলছেন। একই সঙ্গে তার ব্যক্তিগত হিসাবে থাকা অর্থও দেশ থেকে পাচার করা। বাংলাদেশ থেকে কোনো বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে নিতে হলে আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি নিতে হয়। সিলভিয়া গ্রুপকে দেশ থেকে টাকা বিদেশে নেয়ার কোনো অনুমোদন দেয়া হয়নি।

জাহাজ আমদানির নামে তিনি যেসব অর্থ বিদেশে তার মালিকানাধীন কোম্পানিতে স্থানান্তর করেছেন সেগুলো সরাসরি পাচার। আর যেসব অর্থ তিনি দেশ থেকে অন্য পথে স্থানান্তর করেছেন সেগুলোও পাচার। এছাড়া বিদেশে আয় করা অর্থ থেকে খরচ বাদে বাকিটা দেশে আনার নিয়ম রয়েছে। ব্যবসা করে সেগুলো দেশে না আনায় তাও পাচার বলে গণ্য হবে।

বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়, অলসিস হোল্ডিংস লিমিটেড নামে মাল্টার আইআইজি ব্যাংক (মাল্টা) লিমিটেডে থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১১ লাখ ২০ হাজার ডলার বা ৯ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ঋণ নেয়া হয়। পরে ওই অর্থ হলম্যান ফ্যানউইক উইল্যান সিঙ্গাপুরের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়েছে।

একই বছরের ১৬ মার্চ লন্ডনে মাশরেফ ব্যাংক হতে মাল্টার অলসিস হোল্ডিংসের হিসাবে ১৫ লাখ ৫২ হাজার ডলার বা ১৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা স্থানান্তর করে ঋণটি শোধ করা হয়। এছাড়া আলোচ্য হিসাবে একই বছরের ১৩ এপ্রিল ২৫ লাখ ৬৯ লাখ ডলার ২২ কোটি ১০ লাখ স্থানান্তর করা হয়। সিঙ্গাপুরের সোমাপ ইন্টারন্যাশনাল পেট লিমিটেড ২০১৮ সালের ২৬ জুলাই অলসিস হোল্ডিংসের ঋণ হিসাবে ৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার বা ৩ কোটি ১ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়।

তবে মিলন সোমাপ ইন্টারন্যাশনাল হোলম্যানের মালিক বা পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডার নন। অন্যদিকে মাল্টার ট্যালেন্ট মাইল লিমিটেড সিঙ্গাপুরের আরএইচবি ব্যাংকে একই কোম্পানির হিসাবে ২০১৯ সালের ৮ অক্টোবর ১২ লাখ ডলার বা ১০ কোটি ৩২ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়। ঋণের বিপরীতে তার বন্ধকী অর্থও দেশ থেকে পাচার করা।

যুক্তরাজ্যের কোম্পানি হাউসের ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, সিলভিয়া (লন্ডন) লিমিটেডের পরিচালকও মিলন। তিনি সিঙ্গাপুরের সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসের নাগরিক। তার পাসপোর্ট ইস্যু করা হয় ২০১৫ সালে, যার মেয়াদ আছে ২০২৫ সাল পর্যন্ত।

এদিকে বিএফআইইউর অপর এক তদন্তে দেখা যায়, সিঙ্গাপুর ও ব্রিটিশ ভার্জিনিয়ার আইল্যান্ডে দুটি কোম্পানি খুলে দেশ থেকে টাকা পাচার করেছে মুজিবুর রহমান মিলন। সচল জাহাজের বদলে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ২ কোটি ৫ লাখ ডলার বা ১৭৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকার বেশি বিদেশি ওই দুই কোম্পানিতে নিয়ে গেছেন তিনি।

অবাক করা বিষয় হলো, দেশ থেকে জাহাজ আমদানির জন্য যে কোম্পানির নামে এলসি খোলা হয়েছে এবং জাহাজ রফতানি বাবদ যে দুটি কোম্পানিতে বৈদেশিক মুদ্রা স্থানান্তর করা হয়েছে ওই তিনটির মালিক মিলন। ফলে তিনি অত্যন্ত পরিকল্পিভাবে দেশ থেকে টাকা পাচার করেছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, টাকা পাচারের পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মিলন প্রথমে সিলভিয়া শিপট্রেড লিমিটেড নামে সিঙ্গাপুরে এবং অলসিস হোল্ডিং নামে ব্রিটিশ ভার্জিনিয়া আইল্যান্ডে দুটি কোম্পানি খোলেন। এরপর তিনি বাংলাদেশে মেসার্স এস. শিপিং লাইন নামে একটি কোম্পানি খোলেন। বিদেশি ওই দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এস শিপিং লাইন দুটি সচল জাহাজ কেনে।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে সাউথইস্ট ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে ১ কোটি ২৬ লাখ ডলার সিলভিয়া শিপট্রেডে এবং প্রাইম ব্যাংকের জুবিলি রোড শাখা থেকে ৭৮ লাখ ৭৮ হাজার ডলার ব্রিটিশ ভার্জিনিয়া আইল্যান্ডের অলসিস হোল্ডিংয়ের ইতালির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। নতুন জাহাজ বদলে বাংলাদেশে আনা হয় নিম্নমানের স্ক্র্যাপ জাহাজ। যা বলতে গেলে মূল্যহীন।

এ প্রসঙ্গে সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম কামাল হোসেন বলেন, টাকা আদায়ে মিলনের নামে মামলা করা হয়েছে। ঋণের বিপরীতে জমি যে বন্ধক দেয়া সেগুলো বিক্রির চেষ্টা চলছে।

ঋণের বিষয়ে জানতে চেয়ে প্রাইম ব্যাংকের জনসংযোগ বিভাগে ই-মেইল করা হয়। ফিরতি ই-মেইলে জানানো হয়, ঋণের টাকা উদ্ধারের জন্য প্রাইম ব্যাংক ২০১৬ সালে গ্রাহকের বিরুদ্ধে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনে মামলা করেছে। এর আগে ২০১৪ সালে বন্ধকীকৃত জাহাজ বিক্রি করে ১৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা আদায় করেছে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে ব্যাংক আরও ৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা আদায় করেছে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *