সব কনটেইনার অফডকে খালাসের সুপারিশ

অর্থনীতি

স্বদেশবাণী ডেস্ক: কনটেইনার জট কমাতে এবং কাজকর্মে গতিশীলতা আনতে আমদানি করা সব পণ্য অফডকে (বেসরকারি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো) খালাসের সুপারিশ করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।

তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনা মহামারীর কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা শোচনীয়। এ অবস্থায় অফডকে মালামাল খালাসের সিদ্ধান্ত নেয়া হলে তা হবে আত্মঘাতী। এতে ব্যবসার ব্যয় বাড়বে। বন্দরের উচিত হবে, তৃতীয় পক্ষের সহায়তা না নিয়ে নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানো।

গত ১ ডিসেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি দিয়ে সব পণ্য অফডকে খালাসের সুপারিশ করা হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, বিশ্বের অন্য উন্নত বন্দরে সব এফসিএল কনটেইনারের পণ্য আমদানিকারকের চত্বরে বা অফডকে খালাস করা হয়। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা কনটেইনারের ২০-২২ শতাংশ অফডকে খালাস হয়, বাকি ৭০-৭৫ শতাংশ বন্দরের ভেতরে খুলে খালাস করা হয়। ফলে প্রতিদিন বন্দরের অভ্যন্তরে কয়েক হাজার ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান প্রবেশ করে। যা কনটেইনার জট, বন্দরের উৎপাদনশীলতা হ্রাস, রফতানি কার্যক্রমে ধীরগতিসহ সার্বিক নিরাপত্তাও বিঘ্নিত করে। এনবিআর থেকে ৩৭টি আইটেমের পণ্য অফডকে খালাসের অনুমতি রয়েছে। পর্যায়ক্রমে আইটেমের সংখ্যা বৃদ্ধি করে সম্পূর্ণরূপে ডেলিভারি কার্যক্রম আমদানিকারকের চত্বর বা অফডকে স্থানান্তর করা গেলে সমস্যার সমাধান হবে।

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, দেশব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির সময় ডেলিভারির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দফতর ও সংস্থার কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়ায় বন্দরে কনটেইনার জটের সৃষ্টি হয়। যা বন্দরের উৎপাদনশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে নৌ মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে এনবিআর ৩০ জুন পর্যন্ত বন্দরের সব ধরনের পণ্য অফডকে সংরক্ষণ, স্থানান্তর ও খালাসের অনুমতি দেয়। এ সময় অফডকগুলো সুষ্ঠুভাবে কনটেইনার ডেলিভারি দিয়েছে।

এতে বন্দরের গতিশীলতা ফিরে এসে অপারেশনাল পরিচালনা সহজসাধ্য হয় এবং উৎপাদনশীলতা বজায় রাখা সম্ভব হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বন্দরের স্বাভাবিক অপারেশনাল কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে এবং বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট একটি স্থানে জনসমাগম কমাতে সব আইটেমের পণ্য অফডকের মাধ্যমে খালাস যুক্তিযুক্ত বলে মনে করে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

সাধারণ ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা বলছেন, বন্দরের চেয়ে অফডকে পণ্য খালাস করতে প্রায় দ্বিগুণ খরচ হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে একটি ২০ ফুট কনটেইনারের আমদানি পণ্য খালাসে সর্বমোট খরচ (লিফট অন/অফ চার্জ, রিভার ডিউজ, লেবার চার্জ এবং এপ্রেইজিং লেবার চার্জ) হয় ৪ হাজার ৬১ টাকা। সেখানে অফডকে পণ্য খালাসে প্যাকেজ ডেলিভারি চার্জ ৭ হাজার ৯৩০ টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত হয় লিফট অন/অফ চার্জ ১ হাজার টাকা, রিভার ডিউজ ৪০৮ টাকা এবং এক্সট্রা মুভমেন্ট চার্জ প্রায় ৫২ ডলারসহ সর্বমোট ১৩ হাজার ৭৫৫ টাকা। অন্যদিকে ৪০ ফুট কনটেইনারের ক্ষেত্রে বন্দরে সর্বমোট খরচ হয় ৫ হাজার ৬৯৯ টাকা। আর অফডকে সর্বমোট খরচ হয় ১৮ হাজার ৯২ টাকা। অর্থাৎ বন্দরের চার্জের দ্বিগুণের বেশি টাকা খরচ করে আইসিডিগুলো থেকে আমদানিকারকদের পণ্য খালাস করতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে এফবিসিসিআই’র সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, এমনিতেই করোনা মহামারীর কারণে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে পারছে না। তার ওপর নানা কায়দায় ব্যবসার ব্যয় বাড়ানো হলে অনেক ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বন্দরের উচিত তৃতীয় পক্ষের সহায়তা না নিয়ে নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানো।

সব পণ্য অফডকে খালাসের সুপারিশ মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়। তিনি আরও বলেন, বন্দরের গতিশীলতা আনতে গ্রিন চ্যানেল চালু করতে পারে। অতীতের ব্যবসার সুনামের ভিত্তিতে দেশের স্বনামধন্য ব্যবসায়ীদের কাঁচামাল এই চ্যানেল দিয়ে করা যায়। তাছাড়া সব গেটে স্ক্যানার বসানো যায়। তাহলে সব পণ্য কায়িক পরীক্ষা করারও প্রয়োজন পড়বে না। তখন সময় সাশ্রয় হবে। বন্দরে জটও হবে না।

সিদ্দিকুর রহমান আরও বলেন, অফডকে চার্জ বেশি। পণ্য খালাসেও নানারকম বিলম্ব আছে। এ অবস্থায় কোনোভাবেই অফডকে মালামাল খালাসের সিদ্ধান্ত ব্যবসায়ীদের চাপিয়ে দেয়া যাবে না।

চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারী ফোরামের চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা অফডকে কনটেইনার খালাস করতে চায় না। এমনিতেই নানা কারণে ব্যবসার ব্যয় বেড়ে গেছে। তার ওপর অফডকে বাড়তি চার্জ আদায় করা হয়। সময়মতো পণ্য খালাস করে না।

তিনি আরও বলেন, বন্দর সেবামূলক সংস্থা। এ সংস্থার কাজ হচ্ছে ব্যবসায়ীদের সহায়তা দেয়া। কিন্তু তা না করে বন্দর অফডক প্রতিষ্ঠানের পক্ষাবলম্বন করছে, যা মোটেও সমীচীন নয়। বরং অফডকে যে ৩৭টি আইটেমের পণ্য খালাসের অনুমতি দেয়া আছে, তা বন্দর থেকে খালাসের ব্যবস্থা করা উচিত।

বিকেএমইএ’র প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ইতোমধ্যেই রফতানিকারকরা অফডকগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। তারা ইচ্ছামতো চার্জ বাড়ায়, যখন যা খুশি করে। নতুন করে সব পণ্য অফডকে খালাসের উদ্যোগ নেয়া হলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে অফডকগুলো মনোপলি ব্যবসার সুযোগ পাবে।

বর্তমানে ১৯টি অফডকের মধ্যে ১৮টি সচল আছে। এসব অফডকে ৩৯টি আইটেমের পণ্য খালাস হয়। এর মধ্যে কাঁচা তুলা, ওয়েস্ট পেপার, ছোলা, সাদা মটর, খেজুর, পশুখাদ্য, পশুখাদ্যের কাঁচামাল, সোডা অ্যাশ, পেঁয়াজ ইত্যাদি বেশি খালাস হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের মতো অফডকেও পণ্য খালাসের জন্য ৪ দিন ফ্রি টাইম দেয়া হয়। এরপর প্রথম সপ্তাহের জন্য ২০ ফুট কনটেইনারপ্রতি ৭ দশমিক ৩ ডলার, পরের সপ্তাহের জন্য ১৪ দশমিক ৬ ডলার নেয়া হয়।

বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোট অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার বিপ্লব বলেন, অফডকে খরচ কিছুটা বেশি। সেটা ব্যবসায়ীদের জন্য বোঝা হওয়ার কথা নয়। কারণ বন্দরে কনটেইনার পড়ে থাকলে এমনিতেই ডেমারেজ দিতে হয়। তার চেয়ে অফডক দ্রুত খালাস করা যায়। তাছাড়া বন্দরে ৪ দিনের পর থেকে স্টোর রেন্ট হিসাব করা হয়। কিন্তু অফডকে সম্পর্কের ভিত্তিতে ক্ষেত্রবিশেষে ১০ দিনও ফ্রি টাইম দেয়া হয়। তিনি আরও বলেন, ২০০৫ সাল থেকে প্রাইভেট আইসিডিগুলো প্রায় শতভাগ রফতানি পণ্যের কনটেইনার হ্যান্ডেল করছে। তাদের খরচ কি বেড়ে গেছে। শুধু আমদানি পণ্যের বেলায় কেন খরচ বৃদ্ধির প্রশ্ন আসছে।

সামগ্রিক বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, কিছুদিন সব পণ্য অফডকে খালাসের সুযোগ দিয়েছিল এনবিআর। এতে ভালো ফল পাওয়া গেছে।

জাহাজের ওয়েটিং টাইম কমেছে, কনটেইনার জট কমেছে। তাই সব পণ্য অফডকে খালাসের জন্য অনুমতি দিতে এনবিআরকে বলা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা উচ্চ চার্জের যে কথা বলছেন, তা তারা চেম্বারের মাধ্যমে অফডকের মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে ঠিক করে নিতে পারেন। আমরা শুধু বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে এ প্রস্তাব দিয়েছে। বাকিটা সংশ্লিষ্টরা ভেবে দেখবে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *