৬০ পৌরসভায় এক ডজনই ‘বিদ্রোহী মেয়র’

রাজনীতি লীড

স্বদেশবাণী ডেস্ক: দ্বিতীয় ধাপের ৬০টি পৌরসভা নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের জয়জয়কার। শনিবার অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে ৩৮ পৌরসভায় মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মাঠে ছিলেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ২১ জন ও বিএনপির ৯ জন বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন।  বিদ্রোহী এসব মেয়রপ্রার্থীদের মধ্যে এক ডজন জয়ী হয়েছেন।  তাদের এই জয় দুই দলের প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়াকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, বিজয়ী বিদ্রোহী মেয়রদের মধ্যে ছয়জন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে আসছেন, বিএনপির দুজন এবং চারজন অন্য দলের রাজনীতি করে আসছেন।  তারা নিজ দল থেকে মনোনয়ন না পেয়ে প্রার্থী হয়েছেন।

তৃণমূলের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজেদের বলয়ের লোকদের প্রার্থী করায় দলগুলোকে এর মাশুল দিতে হয়েছে। জনপ্রিয় প্রার্থীকে মনোনয়ন না দেওয়ায় অনেক এমপি-মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ প্রার্থীও নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন।

যেসব এলাকায় বিদ্রোহীরা জয়ী হয়েছেন-

আড়ানী : রাজশাহীর আড়ানী পৌরসভায় দলীয় মনোনয়ন পেয়েও পরাজিত হয়েছেন পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুজ্জামান শাহিদ। জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী মুক্তার আলী।

নারিকেল গাছ প্রতীকে তিনি পেয়েছেন ৫ হাজার ৯০৪ ভোট। আওয়ামী লীগের প্রার্থী শহিদুজ্জামান শাহিদ নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন ৪ হাজার ৩০০ ভোট।

এই পৌরসভায় নৌকার প্রার্থী সবচেয়ে কম ৭৭ ভোট পেয়েছে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের কেন্দ্রে। অন্যদিকে এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী পেয়েছেন এক হাজার ১৯৮ ভোট।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আড়ানী আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত।

বেলকুচি : সিরাজগঞ্জের বেলকুচি পৌরসভার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আশানুর বিশ্বাস পরাজিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মো. সাজ্জাদুল হক রেজা জিতেছেন।

রেজার বড় ভাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদবিষয়ক সম্পাদক নুরুল ইসলাম সাজেদুল।

জানা গেছে, এই নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীর পক্ষে কাজ না করে বিদ্রোহী প্রার্থীকে ‘মদদ’ দেওয়ার অভিযোগে তাকেসহ আরও কয়েকজনকে দল থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ করা হয়েছে।

জানা গেছে, পৌর নির্বাচনে দলের মনোনয়নের ক্ষেত্রে মো. সাজ্জাদুল হক রেজা তৃণমূলের ভোটে প্রথম হয়েছিলেন। তারপরও তিনি দলীয় মনোনয়ন পাননি।

সাবেক মন্ত্রী ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আব্দুল লতিফ বিশ্বাস প্রভাব খাটিয়ে তার স্ত্রীকে দলীয় মনোনয়ন পাইয়ে দিয়েছিলেন বলে স্থানীয়ভাবে আলোচনা রয়েছে।

এছাড়া আগে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তার বিরুদ্ধে দলের প্রার্থীর পক্ষে কাজ না করার অভিযোগ রয়েছে।

ফলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের ভোট দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। প্রকাশ্যে এমপির এমন পক্ষপাতিত্বে ভোটের মাঠে পরাজিত হন নৌকার মনোনীত প্রার্থী বেগম আশানুর বিশ্বাস।

ধনবাড়ী : টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মনিরুজ্জামান বিজয়ী হয়েছেন। তিনি পেয়েছেন ৮ হাজার ৯৬৩ ভোট।

তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান মেয়র খন্দকার মঞ্জুরুল ইসলাম তপন পেয়েছেন ৭ হাজার ৮০৪ ভোট।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তৃতীয়বারের মতো মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে মাঠে ছিলেন খন্দকার মঞ্জুরুল ইসলাম তপন।

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কৃষিমন্ত্রী এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাকের আপন মামাতো ভাই তপন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।

মেয়র হওয়ার আগে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি। তবে জনপ্রতিনিধি হিসেবে অভিজ্ঞ হলেও দলে এবার তার মনোনয়ন নিয়ে বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে। তার ফুপাতো ভাই বর্তমানে উপজেলা চেয়ারম্যান।

বীরগঞ্জ : দিনাজপুরের বীরগঞ্জ পৌরসভায় জিতেছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মোশাররফ হোসেন বাবুল। তিনি পেয়েছেন ৩ হাজার ৯৯৩ ভোট।

সেখানে নৌকা প্রতীক পেয়েও পরাজিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. নুর ইসলাম। তিনি পেয়েছেন ৩ হাজার ৯৪৬ ভোট। মোশাররফ হোসেন বাবুল গত নির্বাচনেও বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করে জিতেছিলেন।

এবার বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার পর তাকে পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোশাররফ হোসেন বাবুলের পরিবার এলাকায় বেশ প্রভাবশালী।

তার পরিবারের আরও একাধিক সদস্য আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে নির্বাচন করেও মোশাররফ হোসেন বাবুল প্রায় ৪৬০০ ভোট পেয়ে জিতেছিলেন।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পেয়েছিলেন মাত্র ১৬০০ ভোট। জানা গেছে, পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত নৌকা নিয়ে কেউ নির্বাচিত হতে পারেনি। প্রতিবার ভোটের মাঠে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দলটির অভ্যন্তরীণ কোন্দল।

নাগেশ্বরী : কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী পৌরসভায় দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী মোহাম্মদ হোসেন ফাকুর কাছে পরাজিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ফরহাদ হোসেন ধলু।

নৌকা প্রতীক নিয়েও তিনি পেয়েছেন ৫ হাজার ৭২৬ ভোট। অন্যদিকে বিদ্রোহী প্রার্থী ফাকু ১১ হাজার ৯৭৪ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। এই পৌরসভায় নৌকার প্রার্থী ৬ হাজারের অধিক ভোটে পরাজিত হয়েছেন।

জানা গেছে, এই পৌরসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূলের ভোটে মোহাম্মদ হোসেন ফাকু পেয়েছিলেন ৪৬ ভোট। অপরদিকে ফরহান হোসেন ধলু পেয়েছিলেন মাত্র ৩ ভোট।

কিন্তু ছোটভাই স্থানীয় সংসদ সদস্য হওয়ায় নানা কৌশলে মনোনয়ন বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। যে কারণে নির্বাচনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা তার পক্ষে ছিল না।

স্থানীয় বিরোধের কারণে বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ। ফলে ভোটের মাঠে হেরে যান নৌকার মনোনীত প্রার্থী ফরহাদ হোসেন ধলু।

গাইবান্ধা : গাইবান্ধার সদরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন শাহ মাসুদ জাহাঙ্গীর কবির (মিলন)। এই পৌরসভায় আওয়ামী লীগের আরও তিনজন বিদ্রোহী ছিল।

সেখানে জয়লাভও করেছে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মো. মতলুবর রহমান। অন্য বিদ্রোহী প্রার্থীরা হলেন আহসানুল করিম লাচু ও সদস্য ফারুক আহমেদ এবং মতবুর রহমান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত গাইবান্ধা আওয়ামী লীগের রাজনীতি। একদিকে দলীয় কোন্দল, অন্যদিকে পৌরসভা নির্বাচনের মাঠে একাধিক বিদ্রোহী থাকায় পরাজিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী।

বিএনপির বিদ্রোহী মেয়রপ্রার্থী

দ্বিতীয় ধাপে পৌরসভা নির্বাচনে মাত্র চারটিতে জয় পেয়েছে বিএনপি। প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অনেক পৌরসভায় জনপ্রিয় নেতাদের বাদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

ফলে কয়েকটি পৌরসভায় বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থীরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে দুটি পৌরসভায় দলের বিদ্রোহী প্রার্থী জয়লাভ করেছে।

দল থেকে তাদের মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। উল্টো দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করায় তাদের বহিষ্কারও করা হয়।

দলের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তারা নির্বাচনে অটল থাকে। এমনকি শেষ পর্যন্ত বিজয় লাভ করে। এরা হলেন- সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে আক্তারুজ্জামান আক্তার ও বগুড়ার শেরপুরে জানে আলম খোকা।

বগুড়ার শেরপুরে জানে আলম খোকা স্থানীয়ভাবে বেশ জনপ্রিয়। দল থেকে তাকে মনোনয়ন দিতে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা জোর দাবি জানান।

তৃণমূলের মতামতকে তোয়াক্কা না করে এ পৌরসভা থেকে স্বাধীন কুমার কুণ্ডুকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়। কেন্দ্রের এমন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।

দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নেতাকর্মীরা জানে আলম খোকার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে মাঠে নামেন। খোকাকে নির্বাচন থেকে সরে যেতে নানাভাবে চাপ দেওয়া হয়।

কেন্দ্রীয় নেতারাও কয়েক দফা তার সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচন থেকে সরে যেতে অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি নির্বাচন করবেন বলে সাফ জানিয়ে দেন।

পরে বাধ্য হয়ে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কার হওয়ার পরও ভোট থেকে সরে দাঁড়াননি তিনি।

শনিবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দল মনোনীত প্রার্থীর চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। খোকা পান ৮৭৬৯ ভোট। অন্যদিকে বিএনপির প্রার্থী স্বাধীন কুমার কুণ্ডু পান ৪ হাজার ১৪৪ ভোট।

একই ঘটনা ঘটে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর পৌরসভাতেও। উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আক্তার হোসেন স্থানীয়ভাবে বেশ জনপ্রিয়। তিনি সাবেক মেয়রও ছিলেন।

কিন্তু তার পরিবর্তে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয় মো. হারুনুজ্জামানকে। এ নিয়ে এলাকার নেতাকর্মীরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া না হলেও নির্বাচন করার ব্যাপারে অনড় থাকেন আক্তার হোসেন। ভোট থেকে সরে দাঁড়াতে কেন্দ্রীয় নেতারা তাকে চাপ দেন।

কিন্তু কোনো চাপের কাছেই তিনি নত হননি। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করায় তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।

কিন্তু নির্বাচনে এই বহিষ্কৃত নেতাই মেয়র নির্বাচিত হয়ে যান। তিনি পান ৮ হাজার ৩৭৮ ভোট। অন্যদিকে দলীয় প্রার্থী মো. হারুনুজ্জামান পান মাত্র ৮১৮ ভোট।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *