মানুষ দুটি শেষ পর্যন্ত মারাই গেল

সারাদেশ

স্বদেশ বাণী ডেস্ক :  দেশে মহামারী করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ বা সেকেন্ড ওয়েভে সংক্রমণ ফের বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে রোগী ভর্তি করা নিয়ে নতুন করে সংকটের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। অনেকেই অভিযোগ করছেন- করোনাভাইরাস সন্দেহ হলে রোগীকে জরুরি সেবা না দিয়ে অন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে কিছু হাসপাতালের মধ্যে।

রাজধানী ঢাকার দুটি পরিবার জানিয়েছে- তাদের দুজন রোগীকে নিয়ে একাধিক হাসপাতালে ঘুরেও জরুরি চিকিৎসা পাননি তারা। শেষ পর্যন্ত দুজনই মারা গেছেন।

মৃত্যুর পর জানা গেল তার কোভিড ছিল না
কাশি ও বুকে ব্যথার কারণে বাংলাদেশ রাইফেলসের (বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) সাবেক কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল বারিককে তার পরিবারের সদস্যরা সম্প্রতি ঢাকার শ্যামলীর কাছে একটি সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান।

আব্দুল বারিকের ছেলে মিথুন জামান বলেন, সেখানে তার বাবার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কম দেখে কোভিড-১৯ রোগী ধারণা করে তাকে চিকিৎসা না দিয়ে ফিরিয়ে দেয়া হয়। সেখান থেকে পরামর্শ দেয়া হয়, তাকে কুর্মিটোলা বা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতে।

মিথুন জামান আরও বলেন, “এরপর আমরা কুর্মিটোলা নিয়ে যাই। কিন্তু সেখানকার একজন কর্মকর্তা সিট খালি নেই জানিয়ে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যেতে বলেন”। এরপর জামান তার বাবাকে নিয়ে যান বেসরকারি আনোয়ার খান হাসপাতালে।

তিনি বলেন, “সেখানে জরুরি ভিত্তিতে অক্সিজেন সাপোর্ট দেয়া হলে তার অবস্থার উন্নতি হয়। তাকে সিটি স্ক্যানও করানো হয়। কিন্তু পাঠানো হয় কোভিড ইউনিটে। কিন্তু কোভিড ইউনিটে সিট না থাকায় আমরা পান্থপথে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু কোভিড ধারণা করে তারা জানান তাদেরও কোভিড ইউনিটে সিট খালি নেই”।

কুর্মিটোলা হাসপাতালে যোগাযোগ করা হলে একজন কর্মকর্তা বলেন- গত ৪ ডিসেম্বর তাদের হাসপাতালে শয্যা সংখ্যার অতিরিক্ত রোগী ছিলো। স্থাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বিজ্ঞপ্তিতেও দেখা যায় যে, ওই হাসপাতালে সেদিন কোনও শয্যা খালি ছিলো না।

পরে আব্দুল বারিককে গ্রীণ লাইফ হাসপাতালে নিলে তারা আইসিইউতে ভর্তি করান কিন্তু শুক্রবারেই তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হওয়ায় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। শেষ পর্যন্ত রাত সোয়া ৮টায় তিনি মারা যান।

মিথুন জামান বলেন, “মৃত্যুর পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানালো বাবা কোভিড নেগেটিভ ছিলেন। অথচ সকাল ৬টা থেকে ১২টা পর্যন্ত হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেছি, কিন্তু কেউ ধরতেই চায়নি। সবাই কোভিড সাসপেক্ট মনে করে ভর্তি করেনি। আর মৃত্যুর পরদিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এসএমএস পেলাম যে, বাবা কোভিড নেগেটিভ”।

অথচ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী- গত ৪ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগরীতে ১৯টি হাসপাতালে শয্যা খালি ছিলো ১২৭৩টি আর আইসিইউ বেড খালি ছিলো ১০১টি।

শ্বাসকষ্ট শুনেই জানিয়ে দিলেন সিট খালি নেই
একাধিক হাসপাতালে ঘোরার প্রায় একই ধরণের অভিজ্ঞতা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডেপুটি রেজিস্টার একেএম এমদাদুল হকের পরিবারের সদস্যদেরও। এমদাদুল হকের কন্যা আফরোজা হোসেন বলেন, কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরেও তার বাবা কার্যত কোনও চিকিৎসা না পেয়েই মারা গেছেন।

তিনি বলেন, “গত ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে বাবার শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। বাসায় ইনহেলার দিয়ে চেষ্টা করলাম। কিন্তু অক্সিজেন লেভেল কমে যাওয়া ওই রাতেই শ্যামলীতে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেই কিন্তু তারা রাখলো না। এরপর সেখানেই আরেকটা সুপরিচিত হাসপাতালে নেই। তারা শ্বাসকষ্ট শুনেই জানিয়ে দিলেন যে সিট খালি নেই। এরপর মগবাজারস্থ আরেকটি হাসপাতালে নিলাম। তারা করোনা রিপোর্ট চাইলেন কিন্তু রিপোর্ট নেগেটিভ দেখেও তারা রাখলেন না”।

এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতে নিতে রাত আড়াইটা বেজে গেলো, কিন্তু ঔষধ দিতে দিতে সকাল ৭টা বেজে যায়। আফরোজা হোসেন বলেন, “এরপর ডাক্তার এলো। আমরা বাবাকে কেবিনে নিলাম। ইসিজি করা হলো এবং এর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার বাবা মারা গেলেন”।

অভিযোগের সুরে তিনি বলেন, “অক্সিজেন দেয়া ছাড়া কার্যত কোনো চিকিৎসাই পেলেননা বাবা।”

অথচ গত জুলাই মাসের কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কমিটি রোগীদের যাতে বিনা চিকিৎসায় ফিরতে না হয়, সেজন্য হাসপাতালে বেড ব্যবস্থাপনায় আন্তঃহাসপাতাল নেটওয়ার্কিংয়ের সুপারিশ করেছিলো।

এরপর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কোন হাসপাতালে কত বেড খালি সে সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ করতে থাকলেও করোনা সংক্রমণ কমে আসার প্রেক্ষাপটে তা আর আলোচনায় আসেনি। এমনকি রোগী সংখ্যা কমে আসায় সেপ্টেম্বরে কোভিডের জন্য ডেডিকেটেড ঘোষণা করা হয়েছিলো এমন কয়েকটি হাসপাতালকেও নন-কোভিড ঘোষণা করা হয়।

কিন্তু সম্প্রতি সংক্রমণ আবার বাড়ায় হাসপাতাল থেকে রোগীকে ফিরে যেতে বাধ্য হওয়া কিংবা ভর্তি হতে একাধিক হাসপাতালে দৌড়ানোর ঘটনাও বাড়ছে।

এসব বিষয় নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র হাবিবুর রহমান বলেন, বেড খালি রেখে রোগী ভর্তি না নেয়ার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, “এমন হতে পারে যে, রোগী যখন গেছে ঠিক সে মূহুর্তে খালি ছিলো না। কিন্তু কোভিড বা নন-কোভিড যাই হোক না কেন রোগীকে চিকিৎসা না দেয়ার সুযোগ নেই। এমন কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরাও সেটি দেখবো”।

অন্যদিকে আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডাঃ মুশতাক হোসেন বলছেন- এখন আর রোগী নিয়ে এমন পরিস্থিতি হওয়ার কথা না। তিনি বলেন, “সব হাসপাতালেই নির্দিষ্ট রুম আছে। রোগীকে সেখানে রেখে দরকার হলে কোভিড টেস্ট করে দেখবে। সে অনুযায়ী চিকিৎসা দেবে। কোনো হাসপাতাল রোগীকে যৌক্তিক কারণ ছাড়া ফিরিয়ে দিচ্ছে কি-না তেমন অভিযোগ আসলে অবশ্যই সেটা দেখতে হবে।” -বিবিসি।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *