লেভেল ক্রসিং নিয়ে রেলের ভয়ংকর তথ্য

সারাদেশ

স্বদেশবাণী ডেস্ক: রেলওয়ের লেভেল ক্রসিং যেন মৃত্যুফাঁদ। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা ৮৪ শতাংশ ক্রসিংই অরিক্ষত। আর মোট লেভেল ক্রসিংয়ের প্রায় অর্ধেক অবৈধ। যার সংখ্যা ১ হাজার ১৪৯টি। এসব ক্রসিংয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনা, কেড়ে নিচ্ছে সাধারণ মানুষের জীবন। গত তেরো বছরে রেলে দুর্ঘটনায় ২৯৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। সম্প্রতি জয়পুরহাটে লেভেল ক্রসিং দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১২ জন। চরম ঝুঁকিপূর্ণ ক্রসিংগুলোর বর্তমান অবস্থা ও দুর্ঘটনা নিয়ে খোদ রেলপথ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে এসব ভয়ংকর তথ্য উঠে এসেছে।

রেলপথে পদে পদে ঝুঁকিপূর্ণ-অবৈধ ক্রসিংয়ের ছড়াছড়ি, তা রোববার মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় তুলে ধরা হয়েছে। রেলপথ সচিব মো. সেলিম রেজা এতে সভাপতিত্ব করেন। সভায় ঝুঁকিপূর্ণ ক্রসিংগুলোর দুই পাশে (সড়কে) দ্রুত সময়ের মধ্যে স্পিড ব্রেকার স্থাপনসহ সংশ্লিষ্টদের কয়েকটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া রেললাইন ঘিরে নির্মিত পুরোনো কিংবা সড়কে আন্ডারপাস কিংবা ওভারপাস নির্মাণ, যথাসম্ভব লেভেল ক্রসিং গেটের সংখ্যা কমানো, এলজিইডি কিংবা বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক অবৈধ এবং চরম ঝুঁকিপূর্ণভাবে নির্মিত লেভেল ক্রসিংগুলোয় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। সভায় ৬টি নির্দেশনার সঙ্গে গত বছরের ২৯ অক্টোবর স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় তিনটি নির্দেশনা দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে রেলপথ সচিব মো. সেলিম রেজা যুগান্তরকে জানান, রেলে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন হচ্ছে। উন্নয়নের সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে। কিন্তু বৈধ কিংবা অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোয় পরপর যেসব দুর্ঘটনা ঘটছে, তা নিশ্চয় উদ্বেগের বিষয়। এসব দুর্ঘটনায় আহত-নিহতের সঙ্গে রেলওয়েরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। অবৈধ লেভেল ক্রসিং বন্ধ করাসহ ক্রসিং ঘিরে ওভারপাস ও আন্ডারপাস নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আমরা এমন দুর্ঘটনা দেখতে চাই না। ট্রেন নিজস্ব পথে চলে-শুধ অন্যসব সংস্থা ও সাধারণ মানুষের ভুলের কারণে বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। আমরা কঠোরভাবে এসব নিয়ন্ত্রণ করতে যাচ্ছি।

সভা সূত্রে জানা যায়, রেলের ২ হাজার ৫৬১টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। যার মধ্যে ১ হাজার ১৪৯টি অবৈধ। অর্থাৎ, প্রায় ৪৫ শতাংশ অবৈধ। তবে রেলওয়ের মাঠপর্যায়ের অপর একটি সূত্রের তথ্যমতে, রেলের ২ হাজার ৮৫৬টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। অবৈধ ১ হাজার ৩৬১টি। অর্থাৎ, প্রায় ৪৮ শতাংশ অবৈধ। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে-৩৩টি ক্রসিং কে বা কারা ব্যবহার করছে, তা কেউ জানে না। এছাড়া বৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোর মধ্যে ৬৩২টিতে গেটকিপার নেই। অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোয় যেমন গেটকিপার নেই, নেই কোনো সুরক্ষা সরঞ্জামও। সভায় বলা হয়, ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত শুধু লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৬৩ জন। ২০১৯ সালে ১৮ এবং ২০২০ সালে ১৭ জন মারা গেছেন। উল্লিখিত সময়ে আহত হয়েছেন কমপক্ষে এক হাজার মানুষ। আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় উল্লেখ করা হয়, অবৈধ লেভেল ক্রসিং পুরো রেলওয়েতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। বৈধ কিংবা অবৈধ ক্রসিংগুলোর সড়কে স্পিড ব্রেকার না থাকায় যানচালকরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। ট্রেন আসার আগে লোহার গেটবার ফেলা হলেও প্রায়ই সেসব বার ভেঙে যানচালকরা লাইন পার হতে চান। ওই সময় উনিশ থেকে বিশ হলেই বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোর মধ্যে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ৫১৬টি নির্মাণ করেছে। এছাড়া সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) ১১টি, ইউনিয়ন পরিষদ ৩৬৩টি, পৌরসভা ৭৯টি, সিটি করপোরেশন ৩৪টি, জেলা পরিষদ ১৩টি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ৩টি, বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ ১টি, জয়পুরহাট চিনিকল কর্তৃপক্ষ ১টি, ব্যক্তিপ্রতিষ্ঠান (বেসরকারি) ৩টি, অন্যান্য ৯২টি নির্মাণ করেছে। ৩৩টি অবৈধ লেভেল ক্রসিং কে বা কারা করেছে, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের জানা নেই।

এদিকে গত বছরের ২৯ অক্টোবর অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় তিনটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেখানে স্থানীয় সরকার এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেই কমিটিকে রেলওয়েতে অরক্ষিত (রেল হেটবিহীন) বৈধ-অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা নির্ধারণসহ বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী সুবক্তগীন জানান, অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলো ঘিরে একেকটি চক্র গড়ে উঠেছে। এসব বন্ধ কিংবা নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা প্রয়োজন। পূর্বাঞ্চল রেলে মোট ১ হাজার ৩৭৭টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে, যার মধ্যে ৮১১টি অবৈধ। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান জানান, পশ্চিমাঞ্চলে মোট ১ হাজার ৪৭৯টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে ৫৫০টি অবৈধ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের একাধিক প্রকৌশলী জানান, ঊর্র্ধ্বতন কর্মকর্তাদের লিখিত নির্দেশনা না থাকায় অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলো বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। মূলত কেউ দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না। এতে লেভেল ক্রসিংগুলোয় দুর্ঘটনা বেড়েই চলছে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *