যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো, গাজায় মৃত্যুর মিছিল ও দুর্ভিক্ষ অব্যাহত

আন্তর্জাতিক লীড

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: সম্প্রতি অবরুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষ কবলিত গাজায় তাৎক্ষণিক, নিঃশর্ত ও স্থায়ী যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়।তবে যুক্তরাষ্ট্র সে প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে। এর ফলে গাজায় যুদ্ধবিরতি ও মানবিক সহায়তা পৌঁছানো আবারও হুমকির মুখে পড়ল।

অন্যদিকে এ সময়ের মধ্যে দখলদার ইসরাইলের টানা হামলায় (গত ২৪ ঘণ্টায়) গাজা উপত্যকায় প্রায় ১০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং অব্যাহত সহায়তা অবরোধের কারণে দুর্ভিক্ষ ও মানবিক সংকট আরও প্রকট হয়েছে।

আল-জাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বুধবার প্রস্তাবটির পক্ষে নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের মধ্যে ১৪টি দেশ ভোট দিলেও কেবল যুক্তরাষ্ট্র এর বিপক্ষে ভোট দিয়ে সেটিকে বাতিল করে দেয়।

প্রস্তাবে গাজায় আটক ইসরাইলিদের মুক্তির আহ্বানও জানানো হয়।তবে যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে, যুদ্ধবিরতির বিষয়টি সেই মুক্তির সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত না হওয়ায় এটি ‘শুরুতেই অগ্রহণযোগ্য’।

ভোটের আগে যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ডরোথি শিয়া নিরাপত্তা পরিষদে বলেন, এ প্রস্তাব নিয়ে আমাদের বিরোধিতা নতুন কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান স্পষ্ট—ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে, যার মধ্যে হামাসকে পরাস্ত করা এবং তাদের দ্বারা আর কখনো হুমকির মুখে না পড়ার নিশ্চয়তা অন্তর্ভুক্ত।

চীনের নিন্দা ও মার্কিন বিচ্ছিন্নতা

মার্কিন নীতির নিন্দা জানিয়ে চীনের রাষ্ট্রদূত ফু কং বলেন, দখলদার ইসরাইলের কার্যকলাপ আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের সব রকম সীমা লঙ্ঘন করেছে। কিন্তু একটি দেশের রক্ষাকবচের কারণে এ লঙ্ঘনের জন্য কেউ দায়ী হচ্ছে না।

আল জাজিরার রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা বলেন, এই ভেটো যুক্তরাষ্ট্রকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। সারা বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের বিপক্ষে।

গাজায় সহিংসতা ও দুর্ভিক্ষ: মানবিক সহায়তা নয়, এটি একটি ফাঁদ

আল জাজিরার প্রতিবেদক তারেক আবু আজজুম জানিয়েছেন, দেইর আল-বালাহ ও কেন্দ্রীয় গাজাজুড়ে তীব্র হামলার ঢেউ বইছে।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরাইলি বর্বরতায় কেবল বুধবারই অন্তত ৯৭ জন নিহত ও ৪৪০ জনের বেশি আহত হয়েছেন।

ইসরাইলি বাহিনী মার্কিন-সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (হিএইচএফ) কর্তৃক পরিচালিত সহায়তা বিতরণ কেন্দ্রগুলোর আশেপাশে জমায়েত হওয়া ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের ‘যুদ্ধ এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত করে গুলি চালিয়েছে। গত ২৭ মে থেকে এই কেন্দ্রগুলোর আশেপাশে সহায়তা নিতে আসা শতাধিক মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এবং আরও শত শত ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন।

এর আগে মঙ্গলবার ভোরে খাদ্য সংগ্রহ করতে আসা জনতার ওপর গুলি চালানোর ঘটনা বিশ্বজুড়ে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। হাসপাতালে নিহত রীম আল-আখরাসের ছেলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিল, ‘আম্মু আমাদের জন্য খাবার আনতে গিয়েছিলেন, আর তাতেই তার মৃত্যু হলো।’

তার স্বামী বলেন, ‘প্রতিদিন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। এটি মানবিক সহায়তা নয়, এটি একটি ফাঁদ।’

জাতিসংঘের আহ্বান

এদিকে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা প্রধান টম ফ্লেচার বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘আমাদের পরিকল্পনা আছে, সামর্থ্য আছে, অভিজ্ঞতা আছে। আমাদের কাজ করতে দিন। সমস্ত সীমান্ত ক্রসিং খুলে দিন। সব দিক থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ সাহায্য ঢুকতে দিন।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের গাড়িগুলো যেন বাধাহীনভাবে চলতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।’

জাতিসংঘ দীর্ঘদিন ধরেই ইসরাইল ও গাজার অভ্যন্তরের আইনশৃঙ্খলার অভাবকে মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে প্রধান বাধা হিসেবে দায়ী করে আসছে। ইসরাইল দাবি করে, হামাস সহায়তা চুরি করছে। তবে হামাস দৃঢ়ভাবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বলেছে, ইসরাইলের এমন অভিযোগের কোনো প্রমাণ তারা পায়নি।

শিশুদের দুর্দশা

এদিকে ইউনিসেফের মুখপাত্র জেমস এল্ডার গাজা থেকে বলেন, ‘আমি কিশোর ছেলেদের কাঁদতে দেখেছি, যারা তাদের হাড় বেরিয়ে আসা পাঁজর দেখাচ্ছে। তারা খাবারের জন্য কাকুতি-মিনতি করছে।’

সার্বিক চিত্র

ইসরাইলের দাবি, গাজায় হামাসের হাতে এখনো ৫৮ জন বন্দি রয়েছে, যাদের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জীবিত বলে মনে করা হচ্ছে।

হামাসের হাতে থাকা এই জিম্মিদের উদ্ধার ও হামাসকে পুরোপুরি নির্মূল করার উদ্দেশ্যেই ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরাইলি আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত ৫৪,৬০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।

তবে গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস তাদের মৃতের সংখ্যা ৬১,৭০০-এরও বেশি আপডেট করেছে। জানিয়েছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে নিখোঁজ হাজার হাজার মানুষ মৃত বলে ধারণা করা হচ্ছে।

মূলত এই প্রতিবেদন বিশ্বে ক্রমবর্ধমান চাপ ও বিচ্ছিন্নতার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একক অবস্থানকে আরও স্পষ্ট করেছে। গাজার বিপর্যয়কর মানবিক পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নাড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু যুদ্ধ থামানোর পথ এখনো সুদূর।

 

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *