স্বদেশ বাণী ডেস্ক: শিক্ষকের কাছে বাবার অপমান সইতে না পেরে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রী অধিকারীর (১৪) আত্মহত্যার ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির সামনে বিক্ষোভ করেছেন অভিভাবকরা। এ ঘটনায় মঙ্গলবারের পরীক্ষাও বর্জন করে স্কুলটির শিক্ষার্থীরা। এদিকে এই ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্কুল কর্তৃপক্ষ দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) পরিচালক অধ্যাপক মো. ইউসুফের নেতৃত্বে গঠিত কমিটিকে আগামী ৩ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বেইলি রোডে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে আসেন শিক্ষামন্ত্রী। সেখানে তিনি স্কুলের শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন।
এদিকে শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনায় ঢাকার নামি এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রভাতী শাখার প্রধান শিক্ষক জিন্নাত আরাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে ওই শিক্ষককে মঙ্গলবার সাময়িক বরখাস্ত করা হয় বলে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস জানান।
অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস বলেন, অরিত্রী প্রভাতী শাখায় পড়ত। ডিউটি টিচার তার নকল ধরে শাখাপ্রধানের কাছে যান। পরে শাখাপ্রধান তাকে বহিষ্কার করে পরীক্ষা স্থগিত করেন। পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে শাখাপ্রধানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
মঙ্গলবার সকাল থেকে বেইলি রোডে ভিকারুননিসা স্কুলের গেটের সামনে জড়ো হতে থাকেন অভিভাবকরা। এ সময় তারা দোষী শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের অপসারণ দাবি করেন। অভিভাবকদের অভিযোগ, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে সব সময়েই এ ধরনের বাজে আচরণ করে কর্তৃপক্ষ। অরিত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় বিষয়টি সামনে এসেছে। এ বিষয়ে গভর্নিং বডির কাছে অভিযোগ করার পরও কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি বলে অভিভাবকরা জানান। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ভিকারুননিসার সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বেইলি রোডে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে আসেন শিক্ষামন্ত্রী। এ সময় তিনি স্কুলের শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। শিক্ষকের কাছে বাবার অপমান সইতে না পেরে নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ বলেন, আমি ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত। ঘটনাটি অত্যন্ত হূদয় বিদারক। কেউ অপরাধী হলে অবশ্যই শাস্তি পাবে। তিনি বলেন, একজন শিক্ষার্থী কতটা অপমানিত হলে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়? ঘটনার পেছনের কথাও শুনছি। ঘটনার পেছনে বা ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক, প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল সম্পর্কে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই এটা অভিভাবকদের কাছে আকর্ষণীয় স্থান। অভিভাবকরা তাদের সন্তানকে এখানে পড়াতে চান। জনপ্রিয়তার কারণে স্কুল কর্তৃপক্ষের নানা অনিয়মের কথা আগেও কানে এসেছে। এসব অনিয়মের কারণে টাকার বিনিময়ে ভর্তি বন্ধের উদ্যোগ নেয়া হয়। এখানে ভর্তির জন্য এক সময় ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়া হতো, যা বন্ধ করা হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী জানান, এ ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক অধ্যাপক মো. ইউসুফকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য, সোমবার রাজধানীর শান্তিনগর থেকে অরিত্রীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরিবারের অভিযোগ, স্কুলে নকলের অভিযোগে অপমানের জের ধরে অরিত্রী আত্মহত্যা করেছে। ওইদিন বিকেল সাড়ে চারটায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) চিকিত্সকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই ছাত্রীর গ্রামের বাড়ি বরগুনা সদরে।
এদিকে ছাত্রীর আত্মহত্যার ঘটনায় তিন সদস্যের পৃথক তদন্ত কমিটি গঠনের কথা বলেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। স্কুলটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস সাংবাদিকদের বলেন, এ ঘটনায় আমরা তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন— স্কুলের গভর্নিং বডির সদস্য আতাউর রহমান, খুরশিদ জাহান ও ফেরদৌসী জাহান। তিনি আরো বলেন, যে শিক্ষক তাকে ভর্ত্সনা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে তদন্তে এর প্রমাণ পাওয়া গেলে স্কুলের নিয়ম অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এর আগে অরিত্রীর বাবা সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী দিলীপ অধিকারী বলেন, তার মেয়ে অরিত্রী পরীক্ষার হলে মোবাইলে নকল করছে এমন অভিযোগে সোমবার বাবা-মাকে নিয়ে স্কুলে যেতে বলা হয়। তিনি স্ত্রী ও অরিত্রীকে নিয়ে স্কুলে যান। তারা প্রথমে উপাধ্যক্ষের কক্ষে যান। তারা মেয়ের হয়ে তার কাছে ক্ষমা চান। কিন্তু তিনি তাদের অপমান করে বের হয়ে যেতে বলেন। মেয়ের টিসি নিয়ে যেতেও বলেন তিনি।
এরপর তিনি অধ্যক্ষের কাছে গিয়ে ক্ষমা চান। একপর্যায়ে অরিত্রী তার পা ধরে ক্ষমা চায়। তাতেও কাজ হয়নি। অধ্যক্ষ তাদের অপমানজনক কথাবার্তা বলে তার কক্ষ থেকে বের করে দেন। তিনি আরো বলেন, ওই ঘটনার পর অরিত্রী অধ্যক্ষের রুম থেকে দৌড়ে বের হয়ে যায়। তারাও তার পিছু নেন। স্কুল থেকে বের হয়ে মেয়ে একাই একটি রিকশায় তাদের শান্তিনগরের বাসায় চলে আসে। পরে তারা ফিরে দেখেন, নিজের ঘরে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ওড়না পেঁচানো অবস্থায় ঝুলছে অরিত্রীর নিথর দেহ। দ্রুত তাকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখান থেকে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে কর্তব্যরত চিকিত্সক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।