নওগাঁর রাণীনগরের বিভিন্ন গ্রামে ধুম পড়েছে কুমড়া বড়ি তৈরির

চারণ সংবাদ রাজশাহী লীড

রাণীনগর (নওগাঁ) প্রতিনিধি: নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে কুমড়া বড়ি তৈরির ধুম পড়েছে। আর এই বড়ি তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারিগররা। এই কুমরা বড়ি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে চালান হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। শীতকালই হচ্ছে এই কুমড়া বড়ি তৈরির মৌসুম। রাণীনগর উপজেলার সব চেয়ে বেশি সদর ইউনিয়নের খট্টেশ্বর গ্রামে এই সুস্বাদু কুমড়া বড়ি তৈরি করা হয়ে থাকে।

সরেজমিনে জানা গেছে, অনেক সকাল থেকেই বাড়ির উঠানে উঠানেসহ বিভিন্ন জায়গায় চলে কুমড়া বড়ি তৈরির কাজ। বাড়ির গৃহিণী থেকে শুরু করে পুরুষ এবং ছোট-বড় ও বয়স্ক লোক সবাই মিলে তৈরি করেন কুমড়া বড়ি। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে ফাঁকা রোদ মাখানো বিভিন্ন স্থানে চাটাইয়ের উপড় সারি সারি করে বিছানো সাদা রঙ্গের মাসকালাইয়ের তৈরি কুমড়া বড়ি শুকানো হচ্ছে। কেউ কেউ আবার শুকনো বড়িগুলো বাঁশের চাটাই থেকে খুলছে আবার কেউ কেউ সেই বড়ি সৎকার করছে এ রকম অনেক দৃশ্য চোখে পড়বে। ভোর রাত থেকে শুরু হয় এই কুমড়া বড়ি তৈরির কাজ। এহলো মাসকালাইয়ের কুমড়া বড়ি তৈরির বর্ণনা।

রাণীনগর উপজেলার সব চেয়ে বেশি কুমড়া বড়ি তৈরি করা হয়ে থাকে সদর ইউনিয়নের খট্টেশ্বর গ্রামে। শত বছরের ঐতিহ্যপূর্ণ এই কুমড়া বড়ি বাণিজ্যিক ভাবে তৈরি করে আসছে কারিগররা। খট্টেশ্বর গ্রামের ২০-২৫ টি পরিবারের মানুষ পৈত্রিক এই পেশাটিকে ধরে রেখেছে। এই কটি কুমড়া বড়ি তৈরির কারিগররাই আজো ধরে রেখেছে ঐতিহ্যপূর্ণ এই কুমড়া বড়ির শিল্পটি। সারা বছর টুকটাক বড়ি তৈরি হলেও শীত মৌসুমে এই কুমড়া বড়ি তৈরির ধুম পড়ে যায়। বর্তমানে ওই গ্রামের সকল কারিগররা এই সুস্বাদু কুমড়া বড়ি তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। শীত মৌসুমে এই বড়ির চাহিদা বেশি থাকায় এখন ওই গ্রামে বড়ি তৈরি নিয়ে চলছে কারিগরদের প্রতিযোগিতা। এছাড়াও উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে কুমড়া বড়ি তৈরি হয়ে থাকে তবে খুব সীমিত। শীতের ৬ মাসই মূলত এই বড়িটি তৈরি করা হয়ে থাকে। দিন দিন এর চাহিদা বেড়েই চলেছে কিন্তু বড়ি তৈরির উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় লাভ অনেকটাই কমে গেছে।

বড়ি তৈরির কারিগররা জানিয়েছেন, বড়ি তৈরির সব উপকরণই পুষ্টি গুণ সম্পন্ন খাবার পণ্য। বড়িতে রয়েছে অধিক মানের পুষ্টি। বড়ি তৈরিতে প্রথমে মাসকালাই পানিতে ভিজিয়ে ঘষে পরিস্কার করে মেশিনে ভেঙ্গে গুড়া করে আবার তা পানি দিয়ে ভিজিয়ে রুটি তৈরির আটার মতো অবস্থায় পরিণত করা হয়। এরপর এর সঙ্গে চাল কুমড়া পিষিয়ে অন্যান্য উপকরণ মিশিয়ে বড়ি তৈরি করা হয়। এরপর তা ২-৩ দিন রোদে ভালো ভাবে শুকানোর পর বিক্রয় করা হয়। বড়িকে শক্তিশালী করার জন্য এর সঙ্গে খুব কম পরিমাণে আলো চালের আটা মিশানো হয়। প্রতি কেজি মাসকালাই থেকে প্রায় ৬ থেকে ৭ শ গ্রাম কুমড়া বড়ি তৈরি হয়। এই বড়ি মূলত মাসকালাই, চাল কুমড়া, জিরা, কালোজিরা, মোহরী দিয়ে তৈরি করা হয়। যে কোন রান্না করা তরকারির সঙ্গে এই কুমড়া বড়ি রান্না করা যায়। আর রান্নার পর তরকারিতে এই বড়ি যোগ করে অন্য রকমের এক স্বাদ হয়।

খট্টেশ্বর হাটখোলাপাড়া গ্রামের বড়ি তৈরির কারিগর সুবল চন্দ্র সরকার ও বলায় চন্দ্র সহ আরো অনেকেই জানান, কুমড়া বড়ি তৈরি আমাদের বাপ-দাদার পেশা। তাই আজো এই পেশা করে আসছি। এই বড়ি মূলত মাসকালাই, চাল কুমড়া, জিরা, কালোজিরা, মোহরী দিয়ে তৈরি করা হয়। প্রতি কেজি বড়ি ২২০-২৫০ টাকা (বড় আকারের) এবং ১২০-১৫০ টাকা (ছোট আকারের) করে খুচরা ও পাইকারি বিক্রয় করা হয়। নিজ এলাকার প্রয়োজন মিটিয়ে দেশের উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর, পঞ্চগড়, জয়পুরহাট, লালমনিরহাট, রংপুর ও দক্ষিণাঞ্চলের খুলনা, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এই কুমড়া বড়ি গুলো সরবরাহ করা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিনিয়তই পাইকাররা এসে আমাদের কাছ থেকে এই বড়ি কিনে নিয়ে যায়।

এছাড়া আমরা স্থানীয় বিভিন্ন হাটেও খুচরা বিক্রি করি। তবে বড়ি তৈরির উপকরণের দাম বেশি হওয়াই এবার আমাদের লাভটা খুব কম।

একই গ্রামের বড়ি তৈরির কারিগর মিঠন কুমার সরকার ও জয় কুমার আরো জানান, আমরা নিম্ম আয়ের কিছু মানুষ ঐতিহ্যপূর্ণ এই পৈত্রিক পেশাটিকে আজো ধরে রেখেছি। আমরা বিভিন্ন এনজিও-সংস্থা থেকে ঋন নিয়ে কোন মতে এই শিল্পটাকে ধরে রেখেছি। যার কারণে আমাদের ইচ্ছে থাকলেও এই শিল্পটাকে প্রসারিত করতে পারছি না কারণ আমাদের পুজি কম। আমরা সরকারি সহযোগীতা বা কম সুদে যদি ঋণ পেতাম তাহলে বড় ধরনের অর্থ খাটিয়ে এই শিল্পটাকে আরো অনেক বড় করতে পারতাম। আগের তুলনায় এখন বড়ি তৈরির উপকরণের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় লাভ অনেকটাই কমে গেছে। তবু শত কষ্টেও বাপ-দাদার এই পেশাটি আমরা ধরে রেখেছি।

১নং খট্টেশ্বর রাণীনগর (সদর) ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান পিন্টু জানান, এই গ্রামের তৈরি কুমড়া বড়ির সুনাম রয়েছে। অনেক দুর-দুরান্তের মানুষ এবং ব্যবসায়ীরা এসে এই গ্রামে থেকে কুমড়া বড়ি নিয়ে যায়। তবে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত নিম্ন আয়ের মানুষরা যদি সরকারি ভাবে আর্থিক সহযোগীতা পেতো তাহলে এই শিল্পটি আরো প্রসারিত হতো। আরো অনেক বেকার মানুষদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতো বলে মনে করছেন তিনি।

এ ব্যাপারে রাণীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আল মামুন বলেন, উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে কুমড়া বড়ি তৈরি হয়। কিন্তু খট্টেশ্বর গ্রামটিতেই অনেক বছর যাবৎ বাণিজ্যিকভাবে কুমড়া বড়ি তৈরি করা হয়ে থাকে বলে আমি শুনেছি।

অন্যান্য গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে এই বড়ি তৈরি করা হয় না। তবে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত এখানকার কারিগররা যদি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাহলে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা তাদেরকে যথাসাধ্য সহযোগীতা করার চেষ্টা করবো বলে জানিয়েছেন তিনি।

স্ব.বা/শা

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *