সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহালের দাবিতে আবারও ঢাকার শাহবাগ মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা। মন্ত্রিপরিষদের কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রাখার দাবিতে বৃহস্পতিবার (০৪অক্টোবর) সকাল ৭টা থেকে তারা এই অবরোধ শুরু করেন। গতকাল বুধবার রাত থেকে এই বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু হয়। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে শাহবাগের মোড়ে অবস্থান নেন ৫০ থেকে ৬০ জন। অবরোধে শাহবাগ ও আশপাশের এলাকায় তীব্র যানজট তৈরি হয়।
শাহবাগ মোড় অবরোধ করায় যান চলাচল ব্যাহত হয়। ওই এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। শাহবাগ হয়ে যেসব গাড়ি চলে, সেগুলোকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে দিয়ে ডাইভারশন করা হয়েছে। এলিফ্যান্ট রোড হয়ে মৎস্য ভবন অভিমুখী গাড়িগুলোকেও বিকল্প পথে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। শাহবাগ থানার সামনে পুলিশ রয়েছে। শাহবাগ এলাকায় দায়িত্বরত ট্রাফিকের সহকারী কমিশনার এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের কেন্দ্রীয় সভাপতি শেখ আতিকুর রহমান বলেন, আগামী শনিবার (৬ অক্টোবর) বিকেল তিনটায় শাহবাগে মহাসমাবেশ করবেন তাঁরা। যতক্ষণ না পর্যন্ত দাবি না মানা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা রাজপথ ছাড়বেন না। ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রাখা ছাড়াও তাঁদের অন্য দাবিগুলো হলো, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য সুরক্ষা আইন, রাজাকারের সন্তানদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগ না দেওয়া ও তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা।
পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাত ১০টার দিকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী সমাবেশস্থল এসে বলেন,’ স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকলে দাবি আদায় করা সম্ভব ৷ কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কার দরকার ৷ কতটুকু কোটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, এটা বোঝাতে পারলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপনাদের দাবি মেনে নেবেন।
আপনারা আমাদের আদর্শিক সহযোদ্ধা। আমরা আপনাদের পাশে আছি। এসময় তিনি জনদুর্ভোগ সৃষ্টি না করতেও আন্দোলনকারীদের অনুরোধ করেন। কিন্তু তার আহ্বানের পর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের কেন্দ্রীয় সভাপতি শেখ আতিকুর বাবু বলেন,’ যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের দাবি আদায় না হবে, ততক্ষণ আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব ৷
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সংসদ কমান্ডের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক আল মামুন বলেন, “যতক্ষন পর্যন্ত মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত বাতিল না হয় ততক্ষণ আমাদের কর্মসূচি চলবে। আমরা বলতে চাই, বঙ্গবন্ধুর এই বাংলায় কোন রাজাকারের ঠাই নাই।”
পরে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহালের দাবিতে শনিবার বিকেল ৩ টায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড কেন্দ্রীয় কমিটি একটি সমাবেশ করবে বলে ঘোষণা দেন শেখ আতিকুর বাবু।
শেখ আতেকুর বাবু বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা রাখার জন্য আমরা আগে থেকেই আন্দোলন চালিয়ে আসছি। কোটা নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে যে কমিটি হয়েছে সেই কমিটিকেও আমরা বিভিন্নভাবে আমাদের বার্তা পৌঁছেছি। কিন্তু মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে কোটা নিয়ে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তাতে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা হয়নি। তাই আমরা অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা করেছি। যতোক্ষণ সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের অধিকার নিশ্চিত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত এই অবস্থান কর্মসূচি চলবে।’
সড়কে অবস্থান নেয়ার আগে যথাযথ কর্তপক্ষের অনুমোদন নেয়া হয়েছে এই তথ্য জানিয়ে সংগঠনটির সভাপতি শেখ আতেকুর বাবু বলেন, ‘আমরা অবস্থান নেয়ার পর পুলিশের কর্তৃপক্ষসহ সরকারের বিভিন্ন স্তরের লোক এসেছে। আমরা তাদের সঙ্গে অবস্থান কর্মসূচি নিয়ে আলাপ করেছি। তারা কোনো নেতিবাচক বার্তা দেয়নি।’ শাহবাগ থানা থেকে প্রায় ৩০০ গজ দুরে চলমান এই অবস্থান কর্মসূচির আশেপাশে গতরাতে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ ছাড়া আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অন্য কোনো সদস্যদের দেখা যায়নি।
এর আগে বুধবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে প্রায় শ’খানেক আন্দোলনকারী একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশ থেকে শাহবাগে মোড়ে যায়। পরে সেখানে সবদিকের রাস্তা বন্ধ করে তারা সড়কে অবস্থান নেয়। এতে শাহবাগ ও এর আশেপাশের এলাকায় তীব্র যানজট তৈরি হয়।
বুধবার বৈঠকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের যে সুপারিশ করেছিল সরকারি কমিটি, তাতে অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। অর্থাৎ ৯ম থেকে ১৩ তম গ্রেড পর্যন্ত চাকরিতে কোনো কোটা থাকবে না। এসব পদে নিয়োগ হবে মেধার ভিত্তিতে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ প্রস্তাব অনুমোদন হয়।
সরকারি চাকরিতে বেতন কাঠামো অনুযায়ী মোট ২০টি গ্রেড রয়েছে। এর প্রথম গ্রেডে অবস্থান করেন সচিবরা। আর প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে যারা নিয়োগ পান তাদের শুরুটা হয় নবম থেকে ১৩তম গ্রেডের মধ্যে। একজন গেজেটেড বা নন গেজেটেড প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা নবম গ্রেডে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। এসব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বর্তমানে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা, ১০ শতাংশ জেলা কোটা, ১০ শতাংশ নারী কোটা, ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটা, ও শর্তসাপেক্ষে ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা অর্থাৎ মোট ৫৬ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের বিধান রেখেছে সরকার। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে এই ৫৬ শতাংশ কোটা তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছে সচিব কমিটি। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কোনও কোটা তুলে দেওয়ার ব্যাপারে সুপারিশ দেয়নি ওই কমিটি।
উল্লেখ্য, সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবি বা সংস্কার নিয়ে চাকরি প্রত্যাশীদের অসন্তোষ দীর্ঘদিন থেকেই। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এ অসন্তোষ আন্দোলনে রূপ নিলে তা সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে। এ ঘটনায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা ও আটকের ঘটনা ঘটে। এমন পরিস্থিতিতে গত ১১ এপ্রিল সংসদে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল বা সংস্কারের প্রয়োজন আছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে সচিব কমিটি গঠন করে সরকার। তবে এই কমিটির প্রতিবেদনের সুপারিশ রাখা না রাখা বা পরিমার্জন, পরিবর্ধন করার এখতিয়ার সরকারের।