কথা বললেই ৫’শ টাকা জরিমানা গুনতে হয় প্রতিবেশেীদের! সিংড়ায় ৪ ভাই এক ঘরে

রাজশাহী লীড
আল-আফতাব খান সুইট, নাটোর: ভোগদখলকৃত খাস জমির দখল ছেড়ে দিয়েও রেহায় পায়নি নাটোরের সিংড়া উপজেলার ইটারী ইউনিয়নের দুর্গম বুড়িকদমা গ্রামের বাসিন্দা চার ভাই আব্দুল মান্নান, মোস্তফা ,মোতালেব ও মহব্বত। গ্রাম্য সালিশে দীর্ঘদিন ধরে একঘরে করে রাখা হয়েছে ওই ৪ পরিবারকে। মাতবরদের হুকুম গ্রামের কোন মানুষ তাদের সাথে কথা বললে ৫’শ টাকা জরিমানা গুনতে হবে। ঘরের পাশে মসজিদে নামাজ পড়তে নিষেধ থাকায় তারা গ্রামে নামাজ পড়তে পারেন না। জুমআর নামাজ পড়তে যেতে হয় অন্যগ্রামের মসজিদে। অথচ আব্দুল মান্নান গ্রামের মসজিদের কোষাধক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘ কয়েক বছর। এখন গ্রাম প্রধানদের হুমকির মুখে দুরের গ্রামে গিয়ে নামাজ আদায় করতে হচ্ছে তাদের চার ভাইয়ের পরিবারের সদস্যদের। এক ঘরে রাখা ওই চার পরিবারের সাথে সম্পর্ক রাখায় গ্রাম ছাড়তে হয়েছে ফটিক নামে একজনকে। শ্বাশুরী ও স্ত্রী সন্তান নিয়ে ওই  গ্রাম ছেড়ে এখন পাশের খোলাবাড়িয়া গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন ফটিক। শ্বাশুরী আয়েশা বেগম স্বামীর বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর থেকেই করে চলেছেন আহাজারি। পরিচিত কাউলে দেখলেই ডুকরে কেঁদে ওঠে বিলাপ করেন। এছাড়া জাহিদুল নামে এক প্রতিবেশী মান্নানদের সাথে সম্পর্ক রাখায় তার বাড়ির সামনে বেড়া দিয়ে চলাচলের প্রতিবন্ধ সৃষ্টি করেছে।
ফটিকের শ্বাশুরী আয়েশা বেগম বলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর মেয়-জামাতা ও নাতি-নাতনি নিয়ে স্বামীর ভিটায় বেশ সুখেই দিন কাটছিল তাদের। মান্নানের পরিবারের সাথে সম্পর্ক রাখায় তাদের পরিবারের ওপর নেমে আসে নিযার্তন। মেয়েকে মেরে মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়। জামাই প্রতিবাদ করলে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয় গ্রাম প্রধানদের সমর্থক হাবিল,হামিদুল,রশিদ,রনিসহ ২০ /২৫ জন। বিয়ে হয়ে ওই বাড়িতেই স্বামীর হাত ধরে উঠেছিলাম। প্রায় ৫০ বছর পর ওই বাড়ি ছেড়ে জীবন নিয়ে মেয়ে জামাইয়ের সাথে অন্য গ্রামে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়েছে।
জানা যায়, প্রায় ৮ মাস আগে জিল্লুর রহমান নামে এক ব্যক্তি ওই গ্রামে সরকারী জমি দখল করে বাড়ি করে । এসময় মান্নান পক্ষ মাদ্রাসা নির্মাণের প্রস্তাব দিলে শুরু হয় বিরোধ। গড়ে ওঠে দু’টি পক্ষ। ওই জিল্লুরের  কাছ থেকে মোটা অংকের  নিয়ে তাকে বসবাসের সুযোগ দেয়ার অভিযোগ ওঠে। প্রতিপক্ষ তাকে বসবাসের সুযোগ দেয়া নিয়ে শুরু করে বিরোধ। মান্নান ও তার ভাইদের কোণঠাসা করার জন্য রাতারাতি গ্রামের কিছু মাতব্বর একজোট হয়। পরবর্তীতে মান্নানের বাড়ির পাশে তাদের ভোগদখলকৃত ২০ শতক জমিতে ঈদগাহ মাঠ নির্মাণের প্রস্তাব দেয় মান্নানের প্রতিপক্ষ গ্রামের মাতব্বররা। তারা দিতে অস্বীকৃতি জানালে রাতের আধারে মান্নানের দখলকৃত জমির সকল গাছপালা, সবজি বাগান বিনষ্ট করা হয়। বিষয়টি সিংড়া সার্কেলের এএসপি জামিল আকতার ও সিংড়া থানার ওসি নুর-এ-আলম সিদ্দিকীকে অবহিত করে মান্নান ও তাঁর ভাইয়েরা। এরপর স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলাম সহ দু’পক্ষকে নিয়ে শালিসে ঈদগাহ মাঠ ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। বিনিময়ে মান্নান ও তাঁর ভাইদের মাটিভরাট ও গাছের ক্ষতিপূরণ বাবদ ৭৫ হাজার টাকা দেয়া হয়। এরপর থেকেই মান্নান ও তার পরিবারদের এলাকা থেকে বিতাড়িত করার লক্ষ্যে একঘরে করে রাখে গ্রাম প্রধানরা। সম্প্রতি বিরোধপুন্ন ওই জায়গায় মান্নানের ভাই মোস্তফা গাছ থেকে তাল কাটতে নিষেধ করায় প্রতিপক্ষ  রনির নেতৃত্বে মান্নার ও মোস্তফার  ভাই মোতালেবকে মারপিট এবং কাছে থাকা নগদ টাকা ছিনিয়ে নেয়া হয়। সিংড়া থানায় মোতালেব এর স্ত্রী বাদী হয়ে মামলা করলে পুলিশ রনিসহ তিনজনকে আটক করে।
সরেজমিনে ওই গ্রামে গিয়ে নিয়ে জানা যায়, ওই গ্রামে রয়েছে ঈদগাহ, কবরস্থান ও ১টি মসজিদ। কবরস্থানের পাশেই ঈদগাহ মাঠে ঈদের নামাজ পড়া হয়। ঈদগাহ মাঠ থাকা সত্ত্বেও এলাকার মাতব্বর রেজাউল, আব্দুর রশিদ, আনিসুর, হাবিল, হামিদুল, রশিদ, আনসার ও রনির নেতৃত্বে দল গঠন করে কোণঠাসা করার জন্য মান্নানের বাড়ির সাথে ঈদগাহ মাঠ করা হয়েছে। কোণঠাসা করা হয়েছে মান্নান, তাঁর ভাই মোস্তফা, মোতালেব ও মহব্বতকে। তাদের সাথে গ্রামের কাউকে কথা বলতে দেয়া হয় না। কথা বললে ৫’শ টাকা জরিমানার নির্দেশ রয়েছে। মান্নান ও তার পরিবারের ছেলে মেয়েদের সাথে খেলতে বারণ করা রয়েছে। আব্দুল মান্নানসহ এক ঘরে করে রাখা ওই চার পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, তাদের গ্রাম ছাড়া করার পরিকল্পনা করেছে প্রতিপক্ষরা। একঘরে করে তারা চুপ করে নেই। নতুন নতুন ষড়যন্ত্র করে তাদের কিভাবে গ্রামছাড়া করবে তা নিয়েই তরা ব্যস্থ রয়েছে। সম্প্রতি  তারা  ভূমিদস্যু আখ্যা দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করে প্রতিপক্ষ গ্রুপ। অথচ গ্রামের ২১ বিঘা খাসজমি প্রতিপক্ষ ওই গ্রুপের লোকজন ভোগদখল করে আসছে। আব্দুল মান্নান জানান, আমরা ৪ ভাই। এখানে আমরা আদি বাসিন্দা। আমার বাবা একজন সাধারণ কৃষক ছিলেন। বাড়ির পাশে মসজিদে আমরা দু’শতক জমি দান করে মসজিদ নির্মাণ করেছি। সম্প্রতি পীরস্থানের (পীরবাবা) জমিতে মাদ্রাসা করার পরিকল্পনা ছিলো আমাদের। কিন্তু গ্রামের কয়েকজন মিলিত হয়ে সেখানে একজনকে বসতবাড়ি করতে সহযোগিতা করেছে। আমরা প্রতিবাদ করায় গ্রামের কিছু মানুষ একজোট হয়। বর্তমানে আমাদের একঘরে করে রাখা হয়েছে। গ্রামের সকল কার্যক্রম থেকে বিরত রাখা হয়েছে। মুলত আমাদের গ্রামছাড়া করতে মরিয়া ওই পক্ষ। তিনি আরো বলেন, আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সে কারণে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে যাচ্ছি। তারা আমাদের যেকোন সময় প্রাণনাশ করতে চায়। আমরা আইনের মাধ্যমে সুষ্ঠু সমাধান চাই। কারণ আমরা কোনো অন্যায় করিনি।
প্রতিবেশী জাহিদুল ইসলাম জানান, আব্দুল মান্নান ওতার ভাইয়েরা খেটে খাওয়া মানুষ। তাদের কে অন্যায় ও জুলুম করা হচ্ছে। আমি সত্য কথা বলায় আমার বাড়ির সামনে বেড়া দেয়া হয়েছে। আমার যাতায়াতে বাঁধা সৃষ্টি করা হয়েছে। আমাকে অকট্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়। গ্রাম থেকে বিতারিত ফটিক বলেন, আমি নিরুপায় হয়ে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। মান্নানের পক্ষ নেয়ায় আমাকে মারার হুমকি দেয়া হয়েছে। রাস্তাঘাটে অশব্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়। খুন জখমের হুমকি দেয়া হয়। রাতে দরজা, জানালায় এসে হুমকি দেয়া হয়। আমার তিন মেয়ে। একটি মেয়ে অনার্স ইংরেজিতে পড়ালেখা করে। তার ভবিষ্যৎ ভেবে গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছি। আমার ভাইয়ের বাসা খোলাবাড়িয়ায় আশ্রয় নিয়েছি।
গ্রাম প্রধানদের কাউকে পাওয়া যায়নি। তাবে তাদের স্ত্রী সন্তানরা বলেছেন,গ্রামের কেউ কাউকে একঘরে করে রাখেনি। মান্নানরা চার ভাই গ্রামের মানুষদের বিপদে ফেলতে নানা ফন্দি ফিকির করে যাচ্ছে। নিজেরাই এক ঘরে হয়ে রয়েছে। কাউকে জরিমানা করার কথা সত্যি না। গ্রাম মাতব্বর আব্দুর রমীদের স্ত্রী বলেন,মান্নান মসজিদের ক্যাশিয়ার থাকার সময় প্রায় তিন লাখ টাকা াাত্মসাৎ করেছেন। মসজিদের ইট বালি দিয়ে নিজের বাড়ি মেরামত করেছেন। এসবের প্রতিবাদ করায় গ্রামের বেশ কয়েকজনের নামে মিথ্যা মামলা করে হয়রানি করছেন। তাকে কেউ একগরে করে রাখেনি। নিজে থেকেই এক ঘরে এয় রয়েছেন। কাউকে জরিমানা করার কথা মিথ্যা। ফটিকের শ্বাশুরী শরীকদের সাথে ঝগড়া বিবাদ করে জামাইয়ের সাথে পাশের গ্রামে গেছেন।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আবুল কালাম আজাদ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, মান্নান ও তাদের পরিবারকে একঘরে করে রেখেছে স্থানীয় কিছু ব্যক্তি। ফটিক গ্রাম ছেড়েছে, সে একজন নিরীহ মানুষ।
এ বিষয়ে ইটালী ইউপি চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলাম আরিফ জানান, মান্নানের চার ভাইকে একঘরে করে রাখার বিষয়টি আমি এখনো শুনিনি। তবে এর সত্যতা পাওয়া গেলে বিষয়টি সুরাহা করার জন্য আমি চেষ্টা করবো। তবে একটি খাস জায়গায় মসজিদ করার জন্য গ্রামবাসীর অনুরোধে একটি বৈঠক করে মান্নানদের কাছে থাকা সরকারী ২০ শতক জমি ৭৫ হাজার টাকা দিয়ে মসজিদের নামে নেয়া হয়েছে। পুলিশ ও প্রশাসনের উর্ধতন কতৃপক্ষের উপস্থিতিেিতে এর ফয়শালা হয়েছে। এক ঘরে করে রাখা বা জরিমানা করার বিষয়টি মান্নান বা কেউ আমাকে জানায়নি।
সিংড়া থানার ওসি নুর-এ-আলম সিদ্দিকী সাংবাদিকদের  জানান, কাউকে একঘরে  করে রাখার বিষয়টি আমার জানা ছিলো না। এর আগে ওই গ্রামের একটি বিষয়ে মামলা হয়েছিলো, পুলিশ আসামীদের আটক করে জেলহাজতে প্রেরণ করেছে। এলাকা পরিদর্শন করে একঘরে করে রাখার  সত্যতা পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

স্ব.বা/বা

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *