বাড়ছে সংঘাত প্রাণহানি

জাতীয় লীড

স্বদেশবাণী ডেস্ক: কাউন্সিলর প্রার্থীদের কারণে সহিংসতা বাড়ছে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে। এ পদে দলীয় প্রতীকে ভোট হচ্ছে না।

এ সুযোগে একই ওয়ার্ডে দলের একাধিক প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাদের অতি প্রতিযোগিতার মনোভাবে কোথাও কোথাও প্রতিহিংসায় রূপ নিচ্ছে।

এর নেপথ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা। গত কয়েকদিনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও কয়েকটি পৌরসভা নির্বাচনে দুপক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। এতে চার জন মারা গেছেন। আহত হয়ে হাসপাতালে গেছেন শতাধিক কর্মী-সমর্থক।

সামনের নির্বাচনগুলো ঘিরে সহিংসতার আশঙ্কা আরও বেড়েছে।

সহিংসতার শঙ্কায় কাল শনিবার অনুষ্ঠেয় দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে ৬০টি পৌরসভার মধ্যে ১৬টিতেই নির্দিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

গোয়েন্দা সংস্থা ও স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন অতিরিক্ত এসব সদস্য মোতায়েনের সিদ্ধান্ত দেয়। এর বাইরেও বেশ কয়েকটি পৌরসভায় ভোটের দিন সহিংসতার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এছাড়া ৩১টি পৌরসভায় ভোটের দিন সকালে ভোট কেন্দ্রে কাগজের ব্যালট পেপার পাঠাতে নির্দেশনা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, গোয়েন্দা সংস্থা ও স্থানীয় প্রশাসন আমাদের রিপোর্ট দিয়েছে।

এতে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে রিস্কের (ঝুঁকি) কথা তারা আমাদের জানিয়েছে। ওই এলাকাগুলোতে আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলেছি।

সে অনুযায়ী ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে নির্বাচনে সহিংসতার ঝুঁকি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সব জায়গায় রিস্ক আছে, আবার নেই। এটা ধরেই পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের একাধিক সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও কয়েকটি পৌরসভার রিটার্নিং কর্মকর্তারা নাম গোপন রাখার শর্তে জানান, মেয়র পদের চেয়ে কাউন্সিলর পদে বেশি সহিংস ঘটনা ঘটছে। এর বড় কারণ হচ্ছে আইনগত দুর্বলতা।

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে মেয়র বা চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে ভোট নেওয়ার বিধান আছে। কাউন্সিল পদে নির্দলীয় প্রতীকে ভোট হচ্ছে। এতে রাজনৈতিক দলগুলো মেয়র পদে প্রার্থী মনোনয়ন দিলেও কেন্দ্রীয়ভাবে কাউন্সিলর পদ উন্মুক্ত রাখা হয়েছে।

স্থানীয়ভাবে এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান বা বড় নেতারা তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন দিচ্ছেন। ফলে একই দলের একাধিক কাউন্সিলর প্রার্থী থাকায় সহিংস ঘটনা বেশি হচ্ছে। যেসব নির্বাচনে মেয়র পদে একই দলের একাধিক প্রার্থী রয়েছে সেখানেও সংঘর্ষ ঘটছে। তবে এ সংখ্যা খুব বেশি নয়।

স্থানীয় পর্যায়ে সহিংসতার বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ ছহুল হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, স্থানীয় পর্যায়ের ইস্যু নিয়ে সহিংসতার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এর বড় কারণ হচ্ছে একই পদে একই দলের একাধিক প্রার্থী নির্বাচনী মাঠে থাকা।

তিনি বলেন, একাধিক প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের নিজস্ব অবস্থান রয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ের ইস্যু নিয়ে তারা সহিংসতায় লিপ্ত হচ্ছেন। সরকারি দলের প্রার্থীদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে।

জানা গেছে, পৌরসভা নির্বাচন ঘিরে বুধবার রাতে ঝিনাইদহের শৈলকুপায় ৮ নম্বর ওয়ার্ডের দুই কাউন্সিলর প্রার্থী শওকত হোসেন ও আলমগীর হোসেন খান বাবুর সমর্থকদের মধ্যে সহিংস ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় কাউন্সিলর প্রার্থী শওকত হোসেনের ভাই লিয়াকত হোসেন বল্টু মারা যান।

ওই রাতেই ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী আলমগীর হোসেন খান বাবুর লাশ উদ্ধার করা হয়। প্রার্থী মারা যাওয়ায় ওই ওয়ার্ডের নির্বাচন স্থগিত করেছে ইসি। প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

এ বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. রুকনুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, সহিংসতা হতে পারে এমন তথ্য আগে ছিল না। সহিংস ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য আগ থেকে আমরা তৎপর ছিলাম। গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে পুলিশের পাহারা ছিল। তার মধ্যেই হঠাৎ করে সহিংস ঘটনা ঘটেছে। আমরা আরও তৎপর রয়েছি।

এর আগে মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সহিংসতা ও গোলাগুলির ঘটনায় আলী আজগর বাবুল নামের সরকারি দলের একজন কর্মী মারা গেছেন। ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের দুই কাউন্সিলর প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুর ও আবদুল কাদেরের সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতায় তিনি মারা যান।

আহত হন আরও দুই জন। এ দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর একজন দলীয় সমর্থন পেয়েছেন এবং অপরজন বিদ্রোহী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, হঠাৎই ওই সহিংস ঘটনা ঘটে। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আমরা সতর্ক অবস্থায় আছি।

একইভাবে বুধবার রাতে উঠান বৈঠক করার সময়ে নরসিংদীর মনোহরদী পৌরসভায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী আমিনুল ইসলামের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। ভাংচুর করা হয় মেয়র প্রার্থীর গাড়িসহ বেশ কয়েকটি যানবাহন। পুড়িয়ে দেওয়া হয় অন্তত ৮টি মোটরসাইকেল। এতে অন্তত ১২ জন আহত হন।

একই দিন রাজশাহীর আড়ানী পৌরসভায় আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থী শহিদুজ্জামান শাহিদের পথসভায় গুলি ও বোমা হামলার ঘটনায় ঘটে। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভাগ্নে তুষার (২৮) আহত হন। তাকে সংকটাপন্ন অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের তারাব পৌরসভা নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে মঙ্গলবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। ওই ঘটনায় কাউন্সিলর প্রার্থীসহ কয়েকজনকে আটক করেছে পুলিশ।

নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বিগত অন্যান্য নির্বাচনের তুলনায় এবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থী ও সমর্থকদের মধ্যে সহিংস ঘটনা কম। তবে একই দলের একাধিক প্রার্থীর মধ্যে সহিংসতার প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। এমনকি বিভিন্ন পর্যায় থেকে যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে সেখানে এ ধরনের চিত্র উঠে আসছে। এছাড়া কোথাও কোথাও নির্বাচন ইস্যু বানাতে নানা তৎপরতার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। ওইসব তথ্য অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।

১৬ পৌরসভায় অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন : দ্বিতীয় ধাপে ৬০টি পৌরসভায় শনিবার ভোটগ্রহণ হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে সহিংসতার শঙ্কায় ১৬টিতে নির্দিষ্ট সংখ্যার চেয়ে অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

মাঠ পর্যায়ের গোয়েন্দা সংস্থা ও নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বুধবার এ সংক্রান্ত নির্দেশনাও জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পৌরসভাগুলো হচ্ছে দিনাজপুর (অতিরিক্ত ২ প্লাটুন বিজিবি), মোহনগঞ্জ (র‌্যাবের একটি টিম ও এক প্লাটুন বিজিবি), কমলগঞ্জ (এক প্লাটুন বিজিবি), কুলাউড়া (এক প্লাটুন বিজিবি), কিশোরগঞ্জ (র‌্যাবের একটি টিম ও দুই প্লাটুন বিজিবি), কুলিয়ারচর (র‌্যাবের একটি টিম ও দুই প্লাটুন বিজিবি) ও সাভার (র‌্যাবের একটি টিম ও দুই প্লাটুন বিজিবি)। এছাড়াও রয়েছে- বসুরহাট (২ প্লাটুন বিজিবি), গুরুদাসপুর (র‌্যাবের একটি টিম ও দুই প্লাটুন বিজিবি), খাগড়াছড়ি (র‌্যাবের একটি টিম ও এক প্লাটুন বিজিবি), মোংলাপোর্ট (র‌্যাবের একটি টিম ও দুই প্লাটুন বিজিবি/কোস্টগার্ড), মুক্তগাছা (র‌্যাবের একটি টিম ও এক প্লাটুন বিজিবি) এবং ফুলবাড়িয়া (দুই প্লাটুন বিজিবি)।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সব পৌরসভায় পুলিশের একটি স্ট্রাইকিং ফোর্স ও প্রতি তিন ওয়ার্ডে একটি করে মোবাইল ফোর্স থাকবে। এছাড়া প্রতি তিন ওয়ার্ডে একটি করে র‌্যাবের টিম থাকবে। এক লাখের বেশি ভোটার বিশিষ্ট পৌরসভায় চার প্লাটুন বিজিবি, ৫০ হাজার থেকে এক লাখ ভোটার পর্যন্ত তিন প্লাটুন এবং ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার ভোটার বিশিষ্ট পৌরসভায় দুই প্লাটুন এবং ১০ হাজারের কম ভোটারের পৌরসভায় এক প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার থেকে মাঠে নেমেছেন। উল্লিখিত ১৩টি পৌরসভায় এ সংখ্যার বাইরেও অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।

এছাড়া বগুড়ার শেরপুর, সারিয়াকান্দি ও সান্তাহার পৌরসভার ভোট কেন্দ্রগুলোতে অতিরিক্ত দুই জন পুলিশ সদস্য অস্ত্রসহ মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিটি পৌরসভায় সাধারণ ভোট কেন্দ্রে পুলিশ ও আনসারের ১১ জন সদস্য ও ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ১৩ জন সদস্য মোতায়েন থাকবেন। বগুড়ার এ তিনটি পৌরসভায় এ সংখ্যার অতিরিক্ত হিসাবে দুইজন করে বাড়তি পুলিশ দেওয়া হলো।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *