নিজের কাজটা ঠিকমত কর, তাহলেই দেশের সেবা হবে: বঙ্গবন্ধু

জাতীয় লীড

স্বদেশবাণী ডেস্ক: ‘বঙ্গবন্ধু কেন ৭ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন না? তাহলে সেদিনই আমরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারতাম!’—কেউ কেউ এমন অনুযোগ করেন। আসলে পারতাম না। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ ফিলিস্তিন। ইয়াসির আরাফাত যখন স্বাধীনতার জন্যে অস্ত্র তুলে নিলেন, শত্রুপক্ষ বলল, গণতন্ত্র ও শান্তির পথ ছেড়ে তিনি সশস্ত্র পথ বেছে নিয়েছেন। তখন কিন্তু আরাফাত গোটা পৃথিবীর সমর্থন আর পেলেন না। ফলে আজও ইহুদিরা ফিলিস্তিন দখল করে রেখেছে।

কিন্তু সেদিন সত্যিই কি বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন নি? একদিকে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন, আবার করলেনও না! পক্ষের লোকের কাছে এটা ঘোষণা, আবার বিপক্ষের লোকের কাছে তা নয়। যার ফলে সবরকম প্রস্তুতি নিয়েও পাকিস্তানিরা সেদিন আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারল না।

৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু যখন বলছেন, ‘তোমরা আমার ভাই’—কাকে ‘ভাই’ বলছেন? যার বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ করার নির্দেশ দিচ্ছেন! কী বলছেন? ‘তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না।’ একটু পরেই আবার বলছেন—‘তোমাদের যা-কিছু আছে তা-ই নিয়ে শত্রæর মোকাবেলা করতে হবে।’ কাকে ‘শত্রু’ বলছেন? একটু আগে যাকে ‘ভাই’ বলেছেন!

এভাবেই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও অসামান্য বাগ্মিতার এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছিল ৭ মার্চের সেই ভাষণে—যে কারণে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বক্তৃতাগুলোর একটি হিসেবে এটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে এমন দূরদর্শিতা আমরা বরাবরই দেখেছি। ১৯৭০ সালে দেশের দক্ষিণাঞ্চল ভোলায় একটি সাইক্লোন হয়। তাতে পাঁচ লক্ষাধিক লোকের প্রাণহানি ঘটে। কদিন পরেই ছিল পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন। দেশের এ অবস্থায় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বিবৃতি দিলেন—লক্ষ লক্ষ লাশের ওপর দিয়ে তিনি নির্বাচনে যাবেন না!

আমরা একদল স্বেচ্ছাসেবী তখন ভোলায় ত্রাণকাজে ব্যস্ত। চারদিকে পুঁতিগন্ধময় গলিত লাশের সারি। প্রায় ১০ হাজার লাশ আমরাই কবর দিলাম। সে এক বিভীষিকা! ফলে খুব আলোড়িত হলাম মওলানা ভাসানীর কথায়—ঠিকই তো, চারদিকে এত লাশ, এর মধ্যে নির্বাচনে যাব! এদিকে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন—তিনি নির্বাচনে যাবেন। মনে হলো, এ কেমন নিষ্ঠুরতা! দেশের এমন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু নির্বাচনে যেতে চাইছেন?

কিন্তু তাঁর এ সিদ্ধান্ত যে কতটা সঠিক ছিল, সেটা আমরা বুঝতে পেরেছি পরে। বঙ্গবন্ধু জানতেন—কোনোভাবেই পাকিস্তানিরা আমাদের ক্ষমতায় যেতে দেবে না। তাই তিনি সেদিন নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ফলে পাকিস্তানের জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি কে, তা নিয়ে বিশ্ববাসীর কোনো সংশয় থাকল না।

এ কারণেই অল্প কটি দেশের সরকার ছাড়া সারা পৃথিবীর মানুষ সেদিন বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। একদিকে মার্কিন সরকার আমাদের বিপক্ষে সপ্তম নৌবহর পাঠাচ্ছে, অন্যদিকে সে দেশের জনগণ আমাদের জন্যে তহবিল সংগ্রহ করছে, সংগ্রাম করছে। অর্থাৎ নিজের দেশের সরকারের বিপরীতে দাঁড়িয়েও বিশ্ববাসীর কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু!

এটা কীভাবে সম্ভব হলো? বঙ্গবন্ধু রাজনীতির পাঠ নিয়েছেন শুধু বইপুস্তক পড়ে নয়; বরং মানুষের কাছে গিয়ে। এভাবেই অর্জন করেছেন প্রজ্ঞা ও বাস্তব অভিজ্ঞতা। ফলে এই দেশ ও এদেশের মানুষকে তিনি খুব ভালো বুঝতেন। একদিকে তিনি নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলছেন, আবার ওদিকে প্রস্তুতি নিচ্ছেন স্বাধীনতা সংগ্রামের। তিনি জানতেন তা ছিল অনিবার্য। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক উপায়ে তিনি স্বাধীনতা অর্জনের পথে হেঁটে গেছেন সেই শুরু থেকেই।

বঙ্গবন্ধুর এই রাজনীতি পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। লেনিন বিপ্লব করেছিলেন, কিন্তু গণতান্ত্রিক উপায়ে নয়। তিনি জয়ী হয়েছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবের পথ ধরে। কংগ্রেস ও মুসলীম লীগের যৌথ সংগ্রামে আমরা ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত হয়েছিলাম সত্যি, কিন্তু সেটা একটা অবাস্তব দেশভাগ এবং তা-ও হয়েছে আপসে। জনগণের অংশগ্রহণ তাতে ছিল না।

ব্যক্তিগত জীবনেও এমনই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন বঙ্গবন্ধু। একদিনের কথা মনে পড়ে। ১৯৭২ সালে ঈদের রাতে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে গেলাম। সাথে ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খ্যাতনামা শব্দসৈনিক এবং বেতার ও টেলিভিশনের তৎকালীন মহাপরিচালক এম আর আখতার মুকুল। বুক মিলিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, বস্, তোদের সাথে কথা আছে। লোকজন চলে গেলে বঙ্গবন্ধু আমাদের কাছে বসলেন। আমরা তখন কে কী করছি না করছি, সে-সব খবর তিনি রাখতেন। এম আর আখতার মুকুলকে বললেন, হাসান টিভিতে যায় না কেন? সে বলল, সেটা ওকেই জিজ্ঞাসা করুন!

ঘটনাটা ছিল—মুক্তিযুদ্ধকালে দেশে যে-সব শিল্পী টিভিতে কাজ করেছে, স্বাধীনতার পর টিভিতে তাদের নিষিদ্ধ করা হয় এই অভিযোগে যে, তারা পাকিস্তানপন্থী! কিন্তু আমার বক্তব্য ছিল, তারা অধিকাংশই তো কাজ করেছে বাধ্য হয়ে। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে শুধু তাদের বাদ দিলেই হয়। সবাই নিষিদ্ধ হবে কেন? সরকারি অন্য পেশায় মুচলেকা নিয়ে সবাইকে আত্তীকরণ করা হয়েছে, শিল্পীদের ক্ষেত্রেও সেটা করলেই হয়! আমি শিল্পী সংগঠনের সভাপতি ছিলাম বলে সবাই আমাকে এসে বলত নিজেদের অভাব-অভিযোগগুলো। কথাটা বললাম বঙ্গবন্ধুকে।

শুনে তিনি যা বললেন তা আজও কানে বাজে। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘শোন্, ওসব আমাকে দেখতে দে। ওটা তোর কাজ নয়। তোর কাজ অভিনয় করা। সেটাই মন দিয়ে কর। নিজের কাজটা ঠিকমতো করলেই দেশের সেবা করা হবে।’

(নাট্য ও চলচ্চিত্র জগতের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব এবং আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন অকুতোভয় সাংস্কৃতিক যোদ্ধা সৈয়দ হাসান ইমাম। এক মুক্ত আলোচনার প্রধান অতিথির বক্তব্য ও ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে তিনি এ স্মৃতিচারণ করেন।)

আরকে//

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *