বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম

বিশেষ সংবাদ

স্বদেশবাণী ডেস্ক: গত ৮ মার্চ পালন করা হলো বিশ্ব নারী দিবস। এই একটি দিবসকে ঘিরে নারীদের নিয়ে অনেক হৈচৈ হলেও নারী আসলে প্রতিটি দিবসেই আলোচনার বিষয়। কারণ নারীর বিচরণ এখন সর্বত্র।

একবিংশ শতাব্দীতে এসে নারী শুধু বধূ, মাতা কিংবা কন্যা নয়; পরিবার, সমাজ তথা দেশের উন্নয়নের অংশীদার। পুরুষের পাশাপাশি নারী দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। অনেক সাফল্যের অংশীদার এখন নারী।

‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির- কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’, কবিতার এই পঙক্তিতে শুধু নয়, বাস্তবিক অর্থেই অনেক এগিয়ে গিয়েছে নারী। আজকের দুনিয়ায় এমন কোন কাজ নেই যা নারীরা পারে না। নারী আজ স্বয়ংসিদ্ধা।

পুরুষশাসিত এই সমাজ এবং ধর্মীয় অনুশাসনের বেড়াজাল পেরিয়ে নারীদের আজকের এই অবস্থানে আসার পিছনে কিন্তু কম যুদ্ধ করতে হয়নি। তবে এই যুদ্ধটা যারা শুরু করেছিলেন তাদের ভুলে গেলেও চলবে না।

কারণ বিভিন্ন পেশায় যেসব নারী সাহসী মনোভাব নিয়ে বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে, সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে এগিয়ে গিয়েছেন তারাই তৈরি করেছেন নারীদের জন্য নতুন পথ। সৃষ্টি হয়েছে ইতিহাস। সেই ইতিহাস থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে আজকে অনেক নারীই আরো নতুন ইতিহাস রচনা করার প্রয়াসে এগিয়ে চলেছেন।

তবে এই এগিয়ে যাওয়ার পথে প্রতিনিয়ত স্মরণ রাখতে হবে পূর্বসূরিদের। যারা পথ দেখিয়েছেন, শিখিয়েছেন কিভাবে এগিয়ে যেতে হয়। গভীর সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করতে হবে তাদের ত্যাগের কথা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অনেক ইতিহাস হারিয়ে যায় কালের গহ্বরে।

শুরুটা কিভাবে হলো, কে শুরু করলেন তা নিয়ে তৈরি হয় বিভ্রান্তি। তাই এই প্রতিবেদনে এমন কয়েকজন নারী ব্যক্তিত্বকে তুলে ধরা হলো যারা তাদের প্রফেশনে বাংলাদেশে নারী হিসেবে প্রথম শুরুটা করেছিলেন।

আরেকটু সংক্ষিপ্ত করে বললে, শুধু আইনাঙ্গনের পাঁচজন নারী ব্যক্তিত্বকে নিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই প্রতিবেদন। যাদের তিনজন সরাসরি আইন পেশার সঙ্গে জড়িত। বাকি দুজনের একজন বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা, আর অন্যজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাংলাদেশ পুলিশের একজন কর্মকর্তা। যারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে সৃষ্টি করেছেন ইতিহাস। নারীদের মধ্যে বাংলাদেশে তারাই প্রথম একটি অধ্যায়ের সূচনা করেছেন।

বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা
(বাংলাদেশের প্রথম নারী বিচারক)
দেশ ও বিচার বিভাগের ইতিহাসে নাজমুন আরা সুলতানাই প্রথম নারী বিচারক। ১৯৭২ সালে তিনি ময়মনসিংহের মোমেনশাহী ল’ কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। একই সালের জুলাই মাসে তিনি ময়মনসিংহ জেলা আদালতে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর নাজমুন আরা সুলতানা বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৭৫ সালের ২০ ডিসেম্বর মুনসেফ (সহকারী জজ) হন। একজন নারী হিসেবে তৈরি করেন ইতিহাস।

পরবর্তীতে যোগ্যতাই তাকে ১৯৯১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জেলা জজের আসনে উন্নীত করে। আর এটাও প্রথম কোন নারীর জেলা জজ হওয়ার ঘটনা। নাজমুন আরা সুলতানা হাইকোর্টে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান ২০০০ সালের ২৮ মে। এর দুই বছর পর হাইকোর্টে স্থায়ী হন তিনি।

হাইকোর্টেও তিনি প্রথম। ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি আপিল বিভাগের প্রথম নারী বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন। তৈরি করেন ইতিহাস।

এর মধ্যে ২০১৩ সালের ১ এপ্রিল তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চের নেতৃত্বে বসান বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানাকে। বিচারিক কাজের পাশাপাশি বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা বাংলাদেশ উইমেন জাজেস অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। দুইবার সেক্রেটারি ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব উইমেন জাজেসের।

ব্যারিস্টার ড. রাবেয়া ভূঁইয়া

(বাংলাদেশের প্রথম নারী ব্যারিস্টার)

বাংলাদেশের প্রথম নারী ব্যারিস্টার হওয়ার গৌরব অর্জন করেন ব্যারিস্টার রাবেয়া ভূঁইয়া। নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি হলেন মাইলফলক। ১৯৬৬ সালে ডিস্ট্রিক্ট বার এবং ১৯৬৯ সালে সুপ্রিম কোর্টে সনদপ্রাপ্ত হন। ১৯৭৩ সালে ইংল্যান্ডরে লিংকনস্ ইন থেকে বার এট ল ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

ড. রাবেয়া ভূঁইয়া আপিল বিভাগেরও প্রথম নারী আইনজীবী। ১৯৮৫-৮৭ সাল পর্যন্ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ব্যারিস্টার রাবেয়া ভূঁইয়া।

তিনি ১৯৮৯ সালে প্রথম ব্রিটিশ সিলেবাসের আদলে এলএলবি কোর্স (অনার্স) এর জন্য ভূঁইয়া একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। এ পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠান থেকে সাড়ে ৬ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করে আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন।

পাঁচশ’র বেশি শিক্ষার্থী বার এট ল অর্জন করে আইনাঙ্গনসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করছেন। ২০১৮ সালের ৬ মার্চ ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন রাবেয়া ভূঁইয়াকে  ‘ডক্টর অব লজ’ খতোবে ভূষতি করে। দেশ-বিদেশে নারীদের শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানস্বরূপ তাকে এ স্বীকৃতি দেয়া হয়। তিনি এশিয়ার দ্বিতীয় এবং দেশের প্রথম নারী হিসেবে এ সম্মান অর্জন করেন।

ডা. সুসান গীতি
(বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম নারী মেজর জেনারেল)
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম নারী মেজর জেনারেল পদে নিযুক্ত হন ডা. সুসান গীতি। ২০১৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি এই পদোন্নতি লাভ করেন। সুসান গীতি ১৯৮৫ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন।

পরে ১৯৯৬ সালে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মেডিকেল কোরে ক্যাপ্টেন পদবিতে যোগদান করেন। তিনি ১৯৯৬ সালে প্রথম নারী হিসেবে হেমাটোলজিতে এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করেন।

এছাড়া জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশন এবং বিভিন্ন সামরিক হাসপাতালে প্যাথলজি বিশেষজ্ঞের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। বর্তমানে মেজর জেনারেল ডা. সুসান গীতি সশস্ত্র বাহিনী মেডিকেল কলেজের প্যাথলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

হোসনে আরা বেগম
(বাংলাদেশ পুলিশের প্রথম নারী ওসি)
২০০৯ সালের ১৮ মে বাংলাদেশ পুলিশের প্রথম নারী ওসি (অফিসার ইনচার্জ) হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন হোসনে আরা বেগম। ডিএমপির ক্যান্টনমেন্ট থানায় তাকে প্রথম দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৮১ সালে পুলিশ বাহিনীতে উপ-পরিদর্শক পদে যোগদানের মাধ্যমেই কর্মজীবন শুরু হয় হোসনে আরা বেগমের।

এরপর বিভিন্ন থানায় দায়িত্ব পালন করেন। মৌলভীবাজারে থাকাকালে তিনি ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতি লাভ করেন। স্পেশাল ব্র্যাঞ্চেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। দীর্ঘ ২৮ বছর চাকরি করার পর তিনিই প্রথম নারী ওসি হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।

ব্যারিস্টার ফারিসা কবির
(বাংলাদেশের প্রথম ত্রি-বিচার বিভাগীয় নারী আইনজীবী)

বাংলাদেশের প্রথম ত্রি-বিচার বিভাগীয় নারী আইনজীবী ব্যারিস্টার ফারিসা কবির। তিনটি দেশে একই সঙ্গে আইন প্র্যাকটিস করার অনুমতি রয়েছে তার। তিনি বাংলাদেশের সুপ্রিমকোর্টের একজন অ্যাডভোকেট, ইংল্যান্ডরে লিংকনস্ ইন এর ব্যারিস্টার অ্যাট ল এবং অস্ট্রেলিয়ার ল সোসাইটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস’র সলিসিটর।

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে তিনিই প্রথম বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের নারী আইনজীবী যার পূর্বে আর কোন নারী আইনজীবী একইসঙ্গে তিন দেশে আইন প্র্যাকটিস করার অনুমতি অর্জন করেননি। ব্যারিস্টার ফারিসা কবির ভার্টেক্স চেম্বারস্ (বাংলাদেশ) এবং ভার্টেক্স ইন্টারন্যাশনাল কনসাল্টিং (অস্ট্রেলিয়া) এর প্রতিষ্ঠাতা অংশীদার। এছাড়া বর্তমানে তিনি যৌন হয়রানি, সুরক্ষা ও বহিরাগত সম্পর্ক বিষয়ক পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন সাজিদা ফাউন্ডেশনে।

পরিশেষে বলতে হয়, নারীরা যখন শক্তিরূপা হয়ে ওঠে তখন পৃথিবীতে অনেক বড় পরিবর্তন আসে। তারা শুধু চায় মুক্ত আকাশ, তারা চায় উড়তে। ডানার দাবি তারা জানায় না কখনও, কারণ ইচ্ছেশক্তি তাদের রক্তে। নারী তোমার ডানায় আগুন আছে, দীর্ঘ হোক তোমার উড়ান।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *