স্বদেশবাণী ডেস্ক: দেড় বছর আগে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ভয়াবহ সংক্রমণের পরপরই সর্বত্র নেমে আসে আতঙ্ক। রাজধানীসহ সারা দেশেই প্রতিদিনই বাড়তে থাকে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা। পরিস্থিতি মোকাবিলায় দফায় দফায় কঠোর বিধিনিষেধে সৃষ্টি হয়েছিল ভীতিকর পরিস্থিতি।
নিজেকে নিরাপদ রাখতে পরিবারের সদস্যরাও যথাসম্ভব আক্রান্তদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছিলেন। এমন দুঃসময়েও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সম্মুখযোদ্ধা-চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা (মাঠ পর্যায়ের নমুনা সংগ্রহাকারী, পিসিআর ল্যাবে কর্মরত টেকনোলজিস্ট)।
রাতদিন সেবা দিয়েছেন তারা। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়েও একই ধরনের ব্যস্ত সময় পার করেছেন তারা। করোনা আক্রান্ত হয়ে মারাও গেছেন অনেকে। এ পর্যন্ত প্রাণ গেছে ১৮৬ চিকিৎসক ও ৩৭ নার্সের।
আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ১২২ চিকিৎসক, ২ হাজার ২৮৪ নার্স ও ৪ হাজার ২৯ স্বাস্থ্যকর্মী। তাদের এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজের কথা বিবেচনা করে সরকার বিশেষ সম্মানি (প্রণোদনা প্যাকেজ) ঘোষণা করে।
বরাদ্দ দেওয়া হয় ১৫০ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত বিতরণ করা হয়েছে প্রায় ১১০ কোটি টাকা। কিন্তু কয়েক দফা আবেদনের পরও অদ্যাবধি প্রণোদনার টাকা পাননি তাদের অনেকেই। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
করোনাকালে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল হয়। তবে অধিকাংশই শহরাঞ্চলে। মফস্বলে সরকারি হাসপাতালই ছিল রোগীদের ভরসা। সেই অর্থে প্রায় সারা দেশের চিকিৎসক-নার্সসহ সংশ্লিষ্টরা আক্রান্তদের সেবা দেন।
কিন্তু নানা দেনদরবার ও তদবির করে শহর পর্যায়ের অনেক চিকিৎসক তাদের প্রণোদনার অর্থ তুলতে সক্ষম হয়েছেন। সেই তুলনায় বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা হাসপাতালের চিকিৎসকসহ অন্যরা তা উঠাতে পারেননি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে চাপা ক্ষোভ ও হতাশা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (বাজেট) ড. এনামূল হক যুগান্তরকে বলেন, করোনাকালে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশেষ সম্মানি (প্রণোদনা) বণ্টন হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মাধ্যমে ইতোমধ্যে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে চিকিৎসক-নার্সরা পেয়েছেন।
এ খাতে দেড়শ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল, যার মধ্যে ইতোমধ্যে প্রায় ১১০ কোটি টাকা বণ্টন হয়েছে। বাকি বরাদ্দের অর্থও সংশ্লিষ্টরা প্রাপ্যতা সাপেক্ষে দ্রুত পেয়ে যাবেন।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ যুগান্তরকে বলেন, চিকিৎসকরা প্রণোদনার জন্য নয় বরং দায়িত্ববোধ থেকে রোগীদের সেবা দিয়েছেন।
সেবা দিতে গিয়ে যেমন নিজেরা আক্রান্ত হয়েছেন, তেমনই তাদের পরিবারের অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন। এত ঝুঁকির মধ্যেও পেশাগত নৈতিকতা ও দেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করছেন।
ফলে প্রধানমন্ত্রী খুশি হয়ে প্রণোদনা ঘোষণা দেন। অর্থ মন্ত্রণালয় তা বরাদ্দও দিয়েছে। বর্তমানে মহামারি শেষ হতে চলছে; কিন্তু চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রণোদনা পাচ্ছেন না-এটা দুঃখজনক।
মূলত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও অদক্ষতার ফলে এমনটা হচ্ছে, যা সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। তাদের উদাসীনতায় চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মীদের মনোবল ভেঙে পরবে। পরবর্তী দুর্যোগে এর প্রভাব পড়তে পারে। সুতরাং বরাদ্দকৃত অর্থ দ্রুত পরিশোধ করা উচিত।
যশোরের মনিরামপুর উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সের নার্স নাজমা বেগম যুগান্তরকে বলেন, মহামারির শুরু থেকে কোভিড আক্রান্তদের সেবা দিচ্ছেন। যশোরে প্রথম রোগী শানাক্ত হয় তাদের হাসপাতালে।
কাজের স্বীকৃতি হিসাবে সম্মানি ঘোষণায় খুশি হয়েছিলেন। এজন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দুই দফায় প্রয়োজনীয় তথ্য পাঠিয়েছেন। কিন্তু এখানকার ডাক্তার-নার্স এখন পর্যন্ত কেউ কিছু পায়নি। সর্বশেষ মঙ্গলবার অধিদপ্তর বরাবর আবারও ডাকযোগে তথ্য পাঠিয়েছেন।
রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. মাশহুরুল আলমের অভিযোগ-হাসপাতালে ১৫ দিন ডিউটির পর ১৫ দিন কোয়ারেন্টিনের খরচ সরকারের দেওয়ার কথা।
তিনি মুগদা হাসপাতালের কোভিড আইসিইউতে ১৬ মাস ডিউটি করছেন। কর্তৃপক্ষ প্রথম তিন মাস প্রতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের অংশ হিসাবে হোটেলে থাকা-খাওয়ার খরচ দিলেও বাকি ১৩ মাস নিজের থেকে দিতে হয়েছে।
এ সময় প্রায় ৩ লাখ টাকা চলে গেছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, সরকারি কোভিড হাসপাতালে আইসিইউর মতো স্পর্শকাতর জায়গায় দিনরাত রোগীর সেবা দিয়েছেন।
এজন্য প্রণোদনার কিছু অর্থ পেয়েছেন। হাসপাতালের কোভিড আইসিইউ-১-এ ২৪ জন এবং আইসিইউ-২তে ১৬ জন চিকিৎসককে ১৩ মাস পকেটের টাকা দিয়ে হোটেলে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ার বিভাগ) ডা. এফবিএম আব্দুল লতিফ করোনা আক্রান্ত হয়ে গত বছরের ৬ আগস্ট মারা যান। তার স্ত্রী রোকেয়া বেগম যুগান্তরকে বলেন, অধিদপ্তরের পরিচালক হিসাবে তিনি বিভিন্ন হাসপাতাল গিয়েছেন।
হঠাৎ জ্বরভাব দেখা দিলে ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে আসেন। পরিস্থিতি খারাপ হলে বগুড়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চেস্ট সিটিস্ক্যান করে ৭০ শতাংশ ফুসফুসে সংক্রমণ ধরা পড়ে। চিকিৎসকরা জানান, করোনা আক্রান্তের ফলে এমনটা হয়েছিল।
হাসপাতালে ভর্তি করলে করোনা পজিটিভ আসে। সে সময় রোগীর দিকে বেশি নজর দেওয়ায় আরটিপিসিআর পরীক্ষা রিপোর্টের কপি নেওয়া হয়নি। তাছাড়া ভর্তির ৩৬ ঘণ্টার মধ্যেই স্বামীর মৃত্যু হয়।
এরপর ক্লিনিক্যাল রিপোর্টসহ অধিদপ্তরে দুই দফায় কাগজপত্র জমা দিলেও আরটিপিসিআর ল্যাবের রিপোর্ট না থাকায় মন্ত্রণালয়ে তারা পাঠায়নি। ফলে অবসরকালীন অর্থ পেলেও মৃত্যু ক্ষতিপূরণ বা সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসাবে কোনো প্রণোদনা পাননি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক ডা. ফরিদ উদ্দীন মিঞা যুগান্তরকে বলেন, দেশে করোনা ডেডিকেটেড সরকারি হাসপাতাল ছিল ১৫৪টি।
এর মধ্যে ঢাকার ১৭টি সরকারি ও ৩১টি বেসরকারি হাসপাতালে ৫ হাজার ৪৬৬টি সাধারণ শয্যা এবং ৮০৩টি কোভিড আইসিইউ ও ৪৪৩ কোভিড এইচডিইউ শয্যা রয়েছে।
সারা দেশে করোনা রোগীদের জন্য ১৫ হাজার ৮৬টি সাধারণ, ১ হাজার ২৬২টি আইসিইউ ও ৭৩৩টি এইচডিইউ শয্যা রয়েছে।
তবে দেশের ২ হাজার ২৫৮টি সরকারি হাসপাতালে ও ৯ হাজার ২২৯টি বেসরকারি হাসপাতালের প্রায় সবখানেই করোনা উপসর্গ যুক্ত বা উপসর্গহীন রোগীরা সেবা নিয়েছেন।
ভাইরাসটির প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের পিক টাইমে শয্যার বাইরেও অসংখ্য রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্সরা রোস্টার ডিউটি করেছেন।
এদিকে করোনাকালে সেবাদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা পেতে কতজন চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী আবেদন করেছেন এবং কতজন পেয়েছেন সে তথ্য জানাতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
অধিদপ্তরের বাজেট এবং অর্থ বিভাগের পরিচালক ডা. মো. মঞ্জুরুল আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য তার কাছে নেই। পরিচালকের (প্রশাসন) সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।
পরে যোগাযোগ করা হলে প্রশাসনিক শাখার পরিচালক ডা. শামিউল ইসলামের নির্দেশে সহকারী পরিচালক ডা. মুহাম্মাদ মইনুল হক খান যুগান্তরকে বলেন, তাদের কাছে ১৩২টি হাসপাতাল প্রণোদনার অর্থ পেতে আবেদন করছে।
সেগুলো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে অর্থ প্রেরণ করায় কোন হাসপাতালের কতজন চিকিৎসক কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রণোদনা পেয়েছে সে তথ্য অধিদপ্তরের কাছে নেই।
এছাড়া করোনায় মৃত্যুবরণকারী চিকিৎসক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৮ জনের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য আবেদন করেছে।
এর মধ্যে ১৬ জনের তথ্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে, বাকি দুজনের আবেদন প্রক্রিয়াধীন। এর মধ্যে ১৩ জন ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্র যুগান্তরকে নিশ্চিত করে।
একইভাবে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ড. মো. আব্দুল লতিফ যুগান্তরকে বলেন, করোনা রোগীদের সেবাদানে নিয়োজিত নার্সদের বেতন কাঠামো একেকজনের একেকরকম হওয়ায় প্রণোদনার অর্থও কমবেশি পেয়েছে।
একজন নার্সের সর্বনিু বেসিক (মূল বেতন) ১৬ হাজার টাকা হিসাবে বেসিক অনুযায়ী দুটি প্রণোদনা পেয়েছেন। ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৩ হাজার ৪৭০ জন নার্স প্রণোদনার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে। এর মধ্যে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত ৮ হাজার ৭৪৭ জন পেয়েছে।
অধিদপ্তরের হিসাবে রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৩৭ জন নার্স ও মিডওয়াইফ মারা গেছেন।
এর মধ্যে ১৯ জন সিনিয়র স্টাফ নার্স ৩৭ লাখ ৫০ লাখ টাকা ও ৩ জন সহকারী স্টাফ নার্স ২৫ লাখ টাকা মৃত্যজনিত ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। বাকিদের তালিকা হাতে পাওয়া সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, বছরের ৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সে করোনা রোগীদের সেবার সঙ্গে জড়িতদের জন্য বিশেষ সম্মানী ঘোষণা করেন। মহামারিতে সম্মুখসারির যোদ্ধাদের (চিকিৎসক, নার্সসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মী) প্রণোদনা ছিল দুই মাসের মূল বেতন।
এ ছাড়া করোনা হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকদের ১৫ দিনের দৈনিক ২ হাজার টাকা ভাতা ছিল। করোনা আক্রান্ত হলে চিকিৎসকদের জন্য ৫ থেকে ১০ লাখ টাকার স্বাস্থ্যবিমা এবং মারা গেলে তা পাঁচগুণ হবে।