ফের জঙ্গিবাদে মদদের অভিযোগ

জাতীয়

স্বদেশবাণী ডেস্ক :  বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথের বিরুদ্ধে লাগামহীন অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার পাশাপাশি ফের জঙ্গিবাদে মদদের অভিযোগ উঠেছে। এসব অনিয়মে পিষ্ট হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ডের কুচক্রী সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে ২৫ হাজার শিক্ষার্থী। এর নেপথ্যে রয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান আজিম উদ্দিন আহমেদ ও সদস্য এমএ কাশেম। জঙ্গিবাদে মদদ দেওয়াসংক্রান্ত পর্যাপ্ত প্রমাণাদি যুগান্তরের হাতে রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ব্লগার রাজীবকে ২০১৩ সালে জঙ্গিরা কুপিয়ে হত্যা করে। আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন নাফিস ইমতিয়াজ। এ মামলায় ১০ বছরের সাজাভোগ শেষে তিনি কারামুক্ত হন। এরপর সেপ্টেম্বরে ইমতিয়াজ ফের নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আবেদন করেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার ওই আবেদন গ্রহণ করে তাকে ভর্তির অনুমতি দিয়েছে। এদিকে শনিবার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়কে দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদের কবল থেকে রক্ষার আহ্বান জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে আইন ও মানবাধিকার সুরক্ষা ফাউন্ডেশন নামের একটি সংগঠন। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে রক্ষায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে।

যত অনিয়ম-দুর্নীতি : অনুসন্ধানে জানা গেছে, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনিয়ম ও জঙ্গিবাদে মদদের বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে অসংখ্য অভিযোগ জমা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-বিশ্ববিদ্যালয়টির শীর্ষ ব্যক্তিদের কম মূল্যের জমি বেশি দামে ক্রয় করা হয়েছে। ডেভেলপার্স কোম্পানি থেকে কমিশন নেওয়ার পাশাপাশি ছাত্রদের টিউশন ফি থেকে অবৈধভাবে ট্রাস্টি বোর্ডের ৯ সদস্যের জন্য বিলাসবহুল গাড়ি কেনা হয়।

এক লাখ টাকা করে সিটিং অ্যালাউন্স, অনলাইনে মিটিং করেও সমপরিমাণ অ্যালাউন্স গ্রহণ, নিয়ম ভেঙে বিশ্ববিদ্যালয় ফান্ডের ৪০৮ কোটি টাকা নিজেদের মালিকানাধীন ব্যাংকে এফডিআর করা হয়েছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশনা অমান্য করে ভর্তিও করা হয় কয়েকগুণ বেশি শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ট্রাস্টি ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য- আজিম উদ্দিন আহমেদ ও এমএ কাশেম সিন্ডিকেটের হাতে গোটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই যেন জিম্মি হয়ে আছে।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস করার নামে আজিম উদ্দিন ও কাশেম সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে গত কয়েক বছরে শত শত কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে। পূর্বাচলসংলগ্ন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ২৫০ বিঘা নিচু জমি কিনে ৪২৫ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। আশালয় হাউজিং অ্যান্ড ডেভেলপার্স লিমিটেডের কাছ থেকে কম মূল্যের জমি বেশি দামে কিনেছেন তারা। সেখানে নতুন ক্যাম্পাস করার নামে সাতগুণ বেশি দামে এ নিচু জমি কেনা হয়েছে। ওই সময় (২০১৪) প্রতি বিঘা জমির বাজার দর ছিল ৩০ লাখ টাকা। কিন্তু সেই জমি আজিম-কাশেম সিন্ডিকেট কিনেছে বিঘাপ্রতি দুই কোটি টাকা করে। এর মাধ্যমে তারা আত্মসাৎ করেছেন প্রায় ৪২৫ কোটি টাকা।

আবার সেই নিচু জমি ভরাটের নামেও ৩৫ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। এ আজিম-কাশেম সিন্ডিকেট যে ডেভেলপার্স কোম্পানির কাছ থেকে জমি কিনেছে, সেই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১৪ কোটি টাকা কমিশন নিয়েছে-এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, বায়নার সময় ৪ কোটি টাকা ও পরে জমি রেজিস্ট্রি হওয়ার পর নগদ ১০ কোটি টাকা কমিশন তুলেছে। আশালয় হাউজিং কোম্পানির ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের বনানী শাখার অ্যাকাউন্ট নং-১০৩১২০০০০০০৮৭১ থেকে সাউথইস্ট ব্যাংকের গুলশান শাখার কর্মকর্তা আব্দুর রশিদ নগদ ৫ কোটি টাকা তুলে কাশেমের বাসায় ও প্রিন্সিপাল শাখার কর্মকর্তা কাওসার মাহমুদ আজিমের বাসায় ৫ কোটি টাকা পৌঁছে দেন। আরও জানা গেছে, ২০১৮ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) নানা অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করে। দুদক কর্মকর্তাদের কাছে কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে দুর্নীতির কথা স্বীকার করে।

শিক্ষার্থীদের টাকায় বিলাসবহুল জীবন ট্রাস্টিদের : অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর টিউশন ফির বোঝা চাপিয়ে সেই টাকায় বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা। ছাত্রদের টিউশন ফি থেকে অবৈধভাবে ট্রাস্টি বোর্ডের ৯ সদস্যের জন্য ২৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ব্যয়ে বিলাসবহুল ৮টা রেঞ্জ রোভার ও একটি মার্সিডিস বেঞ্জ গাড়ি ক্রয় করে। এ গাড়ির চালকদের বেতন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং তেলের খরচ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড থেকেই বহন করা হয়। এ আজিম-কাশেম বিশ্ববিদ্যালয়টিকে তাদের অর্থ আয়ের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছেন। যার কারণে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যরা সিটিং অ্যালাউন্স বাবদ প্রতিটি বোর্ড অব ট্রাস্টির মিটিংয়ে ২০১৮ সাল থেকে এক লাখ টাকা এবং অন্যান্য মিটিংয়ের জন্য ৫০ হাজার টাকা করে নিয়ে আসছেন। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পরে তারা তা ৫০ হাজার টাকা ও ২৫ হাজার টাকা করে নেন। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক সিটিং অ্যালাউন্স ফি নির্ধারিত আছে। করোনাকালে অনলাইনে মিটিং করেও সমপরিমাণ অ্যালাউন্স গ্রহণ করেছেন ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা। আজিম-কাশেমের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের সিন্ডিকেটই সব অনিয়ম-দুর্নীতির কলকাঠি নাড়ছে। সিন্ডিকেটের অপর সদস্যরা হলেন-প্রতিষ্ঠাতা সদস্য বেনজির আহমেদ, রেহেনা রহমান, মোহাম্মদ শাহজাহান ও আজিজ আল কায়সার টিটো। আজিম-কাশেম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অমান্য করে আটটি কমিটির বিপরীতে ২৫টি কমিটি গঠন করে অতিরিক্ত সিটিং অ্যালাউন্স আদায় করে। এসব কমিটির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সব ক্ষমতা নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করে রেখেছেন তারা। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈধ-অবৈধ সব কমিটিতেই আজিম বা কাশেম নিয়মবহির্ভূতভাবে সদস্য হয়েছেন।

আরও জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজেরা যে ব্যাংকের পরিচালক, সেই ব্যাংকে বিশ্ববিদ্যালয় ফান্ডের ৪০৮ কোটি টাকা এফডিআর করে রাখেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক সম্পত্তির ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টের মোট অর্থের (২০২১ সালের ৩১ আগস্টের হিসাব অনুযায়ী) ৪৩ ভাগেরও বেশি (৪০৮ কোটি ৪০ লাখ) টাকা নিজেদের মালিকানাধীন সাউথইস্ট ব্যাংকে জমা রেখেছেন। আজিম-কাশেম এবং তাদের স্ত্রীরা উক্ত ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। এ তহবিল দ্রুত সরিয়ে নেওয়ার জন্য ৬ অক্টোবর চিঠি ইস্যু করেছে ইউজিসি। ওই চিঠিতে বোর্ড অব ট্রাস্টিজ সদস্য ও তাদের পরিবারের মালিকানাধীন ও নেতৃত্বাধীন ব্যাংক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় হিসাব এবং তহবিল সরিয়ে নিতে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিকে (এনএসইউ) নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি ২০ অক্টোবরের মধ্যে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বলা হয়।

এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন একাধিকবার সতর্ক করলেও নিয়ম না মেনে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তির অনিয়ম চলছেই। শুধু তাই নয় ভর্তি বাবদ গ্রহণ করা হয় অতিরিক্ত অর্থ। ইউজিসি এ কারণে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ অনুষদে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের জন্য একটি পরামর্শমূলক গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে। এছাড়া আইন অনুষদে বার কাউন্সিলের অনুমোদিত (৩০ জন প্রতি সেমিস্টার) আসনের অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করে। যাদের বার কাউন্সিল সনদ নিয়েও তৈরি হয়েছে চরম অনিশ্চয়তা।

বিগত বছরগুলোর নানা ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে-প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ট্রাস্টি বোর্ডের সিন্ডিকেটের মদদে একরকম জঙ্গি অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়। বিভিন্ন সময়ে জঙ্গিবাদী কার্যক্রমের অভিযোগে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য শিক্ষার্থী আটকও হন, যা দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সম্প্রতি ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডের দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ভর্তি করে নতুন করে জঙ্গি মদদের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্তৃপক্ষ।

ট্রাস্টিদের আত্মীয়দের নিয়োগ : সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, আত্মীয়করণের মাধ্যমেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। আত্মীয়করণের মাধ্যমে এমএ কাশেম তার মেয়ের জামাইকে ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেন এবং অপর ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য বেনজির আহমেদ তার ছেলে রাহাত আহমেদকে প্রধান করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের থেকে নতুন উদ্যোক্তা তৈরির লক্ষ্যে স্টার্টআপ নেক্সট নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যবহার করে নিয়মবহির্ভূতভাবে একটি প্রোগ্রাম চালু করে। এছাড়া ট্রাস্টি বোর্ডের এ সিন্ডিকেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগে নিকটাত্মীয় ও পরিচিতজনদের নিয়োগের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।

উল্লিখিত সব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে মন্তব্য নিতে শনিবার আজিম উদ্দিন আহমেদ ও এমএ কাশেমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তাদের মোবাইল ফোনে এ প্রতিবেদক একাধিকবার কল করলেও তারা কেউ রিসিভ করেননি।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *