শিক্ষিকাকে ‘পতিতা’ বলা নিয়ে উত্তেজনা : কাটাখালীর আদর্শ ডিগ্রি কলেজ অধ্যক্ষের ছত্রছায়ায় শিক্ষক ও পিয়নের অশালীন মন্তব্য

রাজশাহী লীড শিক্ষা

স্টাফ রিপোর্টার: শিক্ষিকাকে ‘পতিতা’ বলা নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পরে কাটাখালীর আদর্শ ডিগ্রি কলেজে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির পিয়ন জিয়ারুল ইসলাম এমন অশালীন উক্তি করেন। এনিয়ে অধ্যক্ষ জয়নাল অবেদীনকে অভিযোগ করা হলে তিনি কোনো প্রতিকার না করে উল্টো শিক্ষিকারা তার অশালীন আচরণের শিকার হন। এনিয়ে অধ্যক্ষকে স্যান্ডেল পেটা করতে চেয়েছিলেন ওই শিক্ষিকা।

এবিষয়টি নিয়ে গতকাল বুধবার (৪ সেপ্টম্বর) দুপুর একটার দিকে অধ্যক্ষের অমন্ত্রণে মিমাংশায় বসে কাটাখালী পৌর মেয়র আব্বাস আলী, কাটাখালী থানার অফিসার ইনচার্জ জিল্লুর রহমানসহ শিক্ষকরা। দীর্ঘ চার ঘণ্টা সভায় অভিযুক্ত জিয়ারুলকে হাজির করতে পারেনি অধ্যক্ষ। তবে সিদ্ধান্ত আসে ওই শিক্ষিকা ও পিয়নকে শোকজ করার। আর সাত দিনের মধ্যে দু’জনকে লিখিতভাবে জানাতে বলা হয়। কিন্তু চার ঘণ্টার সভায় বেরিয়ে আসে থোলের বিড়াল।

বৈঠকে উঠে আসে শিক্ষিকা-ছাত্রীদেরকে যৌন হয়রানির ঘটনাও। ছাত্রীদের মোবাইলে ফোন দিয়ে বিভিন্ন অশালীন কথাসহ এমন ২০ থেকে ২৫টির মত অভিযোগ উঠে আসে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি লিখিত অভিযোগ না থাকায়।

কাটাখালীর আদর্শ ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ জয়নাল আবেদীন।

এবিষয়ে অধ্যক্ষ জয়নাল অবেদীন বলেন, দুই-একটা ঘটনা শুনেছি। তবে কোনো ছাত্রী লিখিত অভিযোগ করেনি। তাই ব্যবস্থাগ্রহণ করতে পারিনি।’ তবে বাকি শিক্ষক-শিক্ষিকা বললেন ভিন্ন কথা, তারা বলেন, অভিযোগ করা হলেও আমলে নেননি অধ্যক্ষ।

অধ্যক্ষ জয়নাল অবেদীনের বিরুদ্ধে রয়েছে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে অর্থ অদায়ের অভিযোগ। অভিযোগ রয়েছে শিক্ষক কলেজ উপস্থিত না থেকে বেতন পাইয়ে দেয়ারও। আবার অধ্যক্ষের ভাই আফসার আলীকে ইংরেজি ও আরেক ভাইকে গন্থগার পদে নিয়োগ দেয়েছেন। আর শ্যালক তোফাজ্জুল হোসেনকে চাকরি দেয়া হয়েছে অর্থনীতি বিভাগে। তবে আফসার আলী কলেজে আসেন না। তিনি ঢাকায় প্রাইভেট পড়ান। এই কলেজের আরেক শিক্ষিকা তাহমিনা জেসমিন। তিনিও থাকেন ঢাকায়। মাস শেষে এসে বেতন উত্তোলন করেন নিয়ে যান। অভিযোগ আছে, ভাগ দিতে হয় অধ্যক্ষ জয়নাল আবেদীন ও অন্য শিক্ষককে।

এছাড়া অভিযোগ রয়েছে শিক্ষিকাকে ‘পতিতা’ বলা সেই পিয়ন জিয়ারুলের চাকরি নিয়েও। অধ্যক্ষ জয়নাল আবেদীন পিয়ন জিয়ারুলকে বাবুর্চি পদে চাকরি দেন। কিন্তু কলেজ পর্যায়ে এমন কোনো পদ নেই বলে জানিয়েছেন একাধিক শিক্ষক। এবিষয়ে অধ্যক্ষ জয়নাল কোনো মন্তব্য করেন নি।

দীর্ঘ দিনের অভিযোগ রয়েছে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ভূগোল বিভাগের শিক্ষক সিরাজুল হকের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে অন্ততঃ ১০ জন ছাত্রীকে কু-প্রস্তাব দেয়ার। এমন অভিযোগ তুলেছেন কলেজের অন্য শিক্ষক-শিক্ষিকারা।

বৈঠকে মেয়র আব্বাস আলী বলেন, ‘স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনি এমন বেশ কিছু অভিযোগ পেয়েছেন।’ অন্যদিকে, শিক্ষক সিরাজুল হক আবার নিয়মিত কলেজে আসেন না। তার পরেও ঠিকমত বেতন উত্তোলন করেন তিনি। সভায় হাজিরা খাতা বের করা হলে সেখানে তথ্য মেলে কলেজে না আসার। তিনি প্রায় ২০ দিনের বেশি কলেজে উপস্থিত হন নি।

 কলেজের অধ্যক্ষ জয়নাল আবেদীনকে সাথে নিয়ে মিমাংসায় বসেন মেয়র আব্বাস, ওসি জিল্লুর।

অধ্যক্ষ জয়নাল আবেদীন বলেন, তার থেকে তিন দিনের ছুটি মোবাইলে নিয়েছেন তিনি। বাকি দিনগুলোর বিষয়ে সভার উপস্থিত থাকা ব্যক্তিরা জানতে চাইলে অধ্যক্ষ বলেন, শিক্ষক সিরাজুলকে শোকজ করবেন বলে মৌখিকভাবে জানান। তবে তিনি ওই শিক্ষকের (সিরাজুল) পক্ষে সাফাই গাইলেন। উল্টো শিক্ষিকাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুললে অধ্যক্ষ বলেন, ‘আপনারা (শিক্ষিকা) স্যারদের (শিক্ষক) মোটরসাইকেলে চড়ে বাড়ি যান। এবিষয়গুলো নিয়ে শিক্ষার্থীরা তাকে (অধ্যক্ষ) অভিযোগ করেছে।’ তবে এই অভিযোগের কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি সভায়।

এবিষয় নিয়ে শিক্ষক সিরাজুল হক বলেন, ‘আমি কলেজে নিয়মিত যায়। পাঁচ দিন স্বাক্ষর করেনি। আমি রাজনীতি করি। তাই কলেজে ঠিকমত আসতে পারিনি। চাকরি থাকা অবস্থান এমন করতে পারে কি জানতে চাইলে তিনি নিজের ভুল স্বীকার করেন। আর ছাত্রীদের কু-প্রস্তাব অভিযোগগুলো মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন।’

প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ জয়নাল অবেদীনের বিরুদ্ধে রয়েছে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ। তিনি যোগদানের পরে বিভিন্ন সময় স্বজনের নিয়োগ দিয়েছে এই প্রতিষ্ঠানে এমন সত্যতা সভায় উঠে আসে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত আছেন ৮৯ জন শিক্ষক-কর্মচারী। এর মধ্যে এমপিও ভুক্ত শিক্ষক রয়েছে মাত্র ২৭ জন। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে অধ্যক্ষ দুই ভাই ও শ্যালককে চাকরি দিয়েছেন। এর মধ্যে এক ভাই আফসার আলী ঢাকায় প্রাইভেট পড়ান। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন উত্তোলন করেন তিনি।

কাটাখালীর আদর্শ ডিগ্রী কলেজের প্রধান ফটক।

এবিষয়ে অধ্যক্ষ জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘অল্প বেতনে চলতে সমস্যা হয়। তাই তিনি ঢাকায় প্রাইভেট পড়ান।’ তিনি কি প্রাইভেট পাড়াতেন পারেন? এমন কথায় কোনো মন্তব্য করেন নি অধ্যক্ষ। কলেজে আরেক শিক্ষিকা তাহমিনা জেসমিন দীর্ঘদিন ধরে আসেন না। তিনি স্বামী-সন্তান নিয়ে ঢাকায় থাকেন। তার স্থানে শ্রী পলাশ মন্ডল নামের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ক্লাস নেন। অভিযোগ : বিনিময়ে অধ্যক্ষ জয়নাল আবেদীন নেন ১০ হাজার ও পলাশ নেন ১০ হাজার টাকা। বাকি টাকা তাহমিনা জেসমিন নিয়ে যান।
কাটাখালী পৌরসভার মেয়র আব্বাস আলী বলেন, এই ঘটনায় দু’জনকে শোকজ করা হয়েছে। কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতিসহ সকল শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়ে মিমাংসার জন্য বসা হবে।

কাটাখালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জিল্লুর রহমান বলেন, উত্তেজনার খবর পেয়ে থানা কলেজে আসেন। এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষিকা ও ছাত্রীদের নিয়ে বাজে কথা বলা হয় এমন কথা শোনা যাচ্ছে। তবে এবিষয়ে নিয়ে কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ করলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর রাজশাহী অঞ্চলের উপ-পরিচালক ড. শরমিন ফেরদৌস চৌধুরী বলেন, কলেজটির অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ তদন্ত চলছে। তবে এই বিষয়টি কোন অভিযোগ পাননি তিনি।

স্ব.বা/শা

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *