’’আরও কষ্ট সহ্য করতে হবে শ্রীলঙ্কার জনগণকে’’

আন্তর্জাতিক লীড

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসেকে কয়েক মাস ধরে বলা হয়েছিল, দেশটির অর্থনীতি পতনের মধ্যে রয়েছে। পর্যটনে গুরুতর আঘাত করেছিল কোভিড-১৯ মহামারি। এরপর যখন পর্যটকরা ফিরতে শুরু করলো, তখনই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এতে জ্বালানি ও খাদ্যের দাম বেড়ে যায় ব্যাপক হারে।

তবে শ্রীলঙ্কার জন্য বাহ্যিক ধাক্কাগুলো ছিল সমস্যার একটি অংশ মাত্র। দেশটির দুর্ভোগের প্রধান কারণ অব্যবস্থাপনা। এর জন্যই গত ৯ জুলাই প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসে তাণ্ডব চালায় বিক্ষোভকারীরা। রাজাপাকসে ভাইদের বড় ভুল ছিল, তারা সরকারকে পারিবারিক ব্যবসার মতো চালিয়েছিলেন, যার জন্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়, মুদ্রার মূল্যমানে ধস নামে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ফাঁকা হয়ে যায়।

এরপর প্রবেশ ঘটে রনিল বিক্রমাসিংহের। গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছেড়ে পালানোর এক সপ্তাহের মাথায় গত ২১ জুলাই প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন তিনি। শ্রীলঙ্কাকে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট থেকে টেনে তোলার ভার পড়েছে বিক্রমাসিংহের কাঁধে। তবে এখানো রাস্তা ছাড়েনি বিক্ষোভকারীরা। বিদ্যুৎ, খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধের ঘাটতির বিষয়ে জনমনে ক্ষোভ কমেনি। এরপরও যেভাবেই হোক, জনগণকে আরও কষ্ট সহ্য করার জন্য রাজি করাতে হবে রনিল বিক্রমাসিংহেকে। কারণ শ্রীলঙ্কার ঘুরে দাঁড়াতে যেসব সংস্কার দরকার, তার জন্য আরও ত্যাগস্বীকার জরুরি।

লঙ্কান পার্লামেন্ট আরও অনুপ্রেরণাদায়ক কাউকে সরকারপ্রধান হিসেবে বেছে নিতে পারলো না, এটি লজ্জাজনক। বিক্রমাসিংহে ১৯৭৭ সালে প্রথম আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন এবং ছয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার সাম্প্রতিক কর্মকাল শুরু হয় চলতি বছর গোতাবায়া রাজাপাকসের অধীনে, যার বড় ভাই সবেমাত্র প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন।

বিক্ষোভকারীরা বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি। তারা গত ৯ জুলাই বিক্রমাসিংহের বাড়িতে আগুন দেয়। পদোন্নতি নয়, তার পদত্যাগের দাবি ছিল বিক্ষোভকারীদের। তাকে প্রেসিডেন্ট পদের যোগ্য বলে মনে করা লঙ্কানদের সংখ্যা খুব কম। অনেকেই বিক্রমাসিংহেকে রাজাপাকসেদের হাতের পুতুল হিসেবে দেখেন। তার ক্ষমতা পাওয়ার পেছনেও রাজাপাকসেদের দলের অবদান বেশি।

এই বিষয়গুলো বিক্রমাসিংহের কাছে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করা আরও কঠিন করে তুলবে। তবে তিনি নিজেই কাজটা আরও কঠিন করে তুলছেন বলে দেখা যায়। বিক্রমাসিংহের মন্ত্রিসভা আর পূর্বসূরীর মন্ত্রিসভা প্রায় এক। তার মনোনীত প্রধানমন্ত্রী রাজপাকসে পরিবারের ঘনিষ্ঠ মিত্র। বিক্রমাসিংহে নিজেও কিছুটা স্বৈরাচারী মনোভাব দেখিয়েছেন। বিক্ষোভকারীদের ‘ফ্যাসিবাদী’ বলে মন্তব্য করেছেন, কারফিউ জারি করে দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন। শপথ নেওয়ার একদিন যেতে না যেতেই বিক্ষোভকারীদের প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের পাশ থেকে জোরপূর্বক তুলে দিয়েছেন, যদিও তারা নিজেরাই সরে যাওয়ার প্রুতিশ্রুতি দিয়েছিল।

শ্রীলঙ্কায় এখন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত বিক্রমাসিংহের। নমনীয় পদক্ষেপ তাতে সাহায্য করতে পারে। ভালো বিষয় হলো, তিনি বিক্ষোভকারীদের নির্ধারিত এলাকায় থাকতে দিয়েছেন, যা তার কার্যালয় থেকে খুব বেশি দূরে নয়। সরকারে বিরোধী দলীয় সদস্যদের আমন্ত্রণ জানিয়ে আরও সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ এবং নিজের বৈধতা বাড়িয়ে তুলতে পারেন লঙ্কান প্রেসিডেন্ট।

আরও ভালো হয়, বিক্রমাসিংহে যদি গণতন্ত্রের প্রতি নিজের প্রতিশ্রুতি প্রদর্শনে নতুন নির্বাচনের জন্য একটি সময়সীমা ঘোষণা করেন। অবিলম্বে নির্বাচন আয়োজনে মূল্যবান সময় ও সম্পদ নষ্ট হবে। কিন্তু আগামী বসন্তের মধ্যে পার্লামেন্টের মেয়াদ অর্ধেকে পৌঁছে যাবে এবং প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিক্রমাসিংহের কাছে এটি ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতাও থাকবে। তাহলে তখন কেন নয়?

লঙ্কান প্রেসিডেন্টের দ্বিতীয় প্রধান কাজ হলো আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে বেইলআউট প্যাকেজের বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছানো। শ্রীলঙ্কার দুর্দশা সম্পর্কে প্রশংসনীয়ভাবে সৎ ছিলেন বিক্রমাসিংহে। দেশ ‘দেউলিয়া’ হয়ে গেছে স্বীকার করেছেন তিনি। রাজাপাকসেরা অন্তঃসারশূন্য প্রকল্প চালাতে শত কোটি ডলারের ঋণ নিয়েছেন। এরপর ট্যাক্স কমানো ও সরকারি।

চাকরিতে পদ বাড়ানোর নীতি প্রণয়ন করেন, যা বাজেট ঘাটতি বাড়িয়েছে। এর বিপরীত কাজ দিয়েই শুরু করতে হবে বিক্রমাসিংহেকে। নতুন সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত চাকরি, বেতন অথবা উভয়ই কমিয়ে সরকারি খাতের মজুরি বিল সংকুচিত করা। ট্যাক্স বাড়াতে হবে। জাতীয় বিমান সংস্থার মতো রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলো বিক্রি করে কিছু অর্থ উপার্জন করা যেতে পারে।

রনিল বিক্রমাসিংহে শ্রীলঙ্কানদের ভবিষ্যৎ দুর্ভোগের জন্য প্রস্তুত করছেন, তবে তাকে আরও বেশি করতে হবে। দেশটির অর্থনৈতিক সংকট অন্তত আগামী বছরের শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। ঋণদাতারা শ্রীলঙ্কার ঋণ পুনর্গঠন নিয়ে আলোচনায় শক্ত দর কষাকষি করবে। অনেকে হয়তো এসব কঠিন সত্য অন্য কারও মুখ থেকে শুনতে চাইবে। কিন্তু যারা বিক্রমাসিংহেকে চেনেন, তাদের মতে, তিনি একজন চতুর রাজনীতিবিদ, যার নিজস্ব বুদ্ধি-বিবেচনা রয়েছে। এখন সময় এসেছে সেটি প্রমাণ করার।

স্ব.বা/ রু.

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *