খেলাপিতে হাবুডুবু খাচ্ছে ব্যাংক, ছাড়াল এক লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা

জাতীয় বিশেষ সংবাদ লীড

স্বদেশ বাণী ডেস্ক: কেউ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না, আবার কেউ অনিয়ম করে যোগসাজশের মাধ্যমে নামে-বেনামে নিচ্ছে অর্থ। সেটিও আদায় হচ্ছে না। এতে ব্যাংকগুলো খেলাপিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। সবশেষ হিসাব অনুযায়ী খেলাপি ঋণ রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে এক লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এ যাবৎকালে এটিই সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণের অঙ্ক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। রোববার (১৩ নভেম্বর) এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৩৬ হাজার ১৯৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, করোনা মহামারির সময় ব্যাংকঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে দেওয়া হয়েছিল বিশেষ ছাড় ও বিভিন্ন ধরনের সুবিধা। বছরের শুরুতে তা তুলে নেওয়ার পর ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। এখন উচ্চ খেলাপির ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। কারণ আন্তর্জাতিক মানদÐ অনুযায়ী খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সহনীয় বলে ধরা হয়। বাংলাদেশে এটি এখন ৯ শতাংশের বেশি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৩৬ হাজার ১৯৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

দ্বিতীয় প্রান্তিকে অর্থাৎ চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণ ছিল ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ছিল এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৯ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা।
একের পর এক ছাড় দিয়ে আসলে ঋণ আদায় করা যাবে না। সিদ্ধান্ত নিতে হবে ভেবেচিন্তে। আগে বুঝতে হবে কোন কোন সমস্যার জন্য খেলাপি ঋণ আদায় হচ্ছে না। আর এ বিষয়গুলো যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানে না তাও নয়। তারা অবশ্যই জানে, শুধু পদক্ষেপ নিতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ

২০২১ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এ হিসাবে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩১ হাজার ১২২ কোটি টাকা। তবে গত বছরের সেপ্টেম্বরের সঙ্গে তুলনা করলে খেলাপি ঋণ ৩৩ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা বেড়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ১২ শতাংশ।

                                          # তিন মাসে বাড়ল ৯ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা
                                       # এক বছরে বেড়েছে ৩৩ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা
                                    # ঋণ আদায়ে সরাসরি ‘অ্যাকশনে’ যাওয়ার পরামর্শ

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহামারি করোনার সময় অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবিলায় গত দুই বছর কোনো টাকা পরিশোধ না করেও খেলাপি হয়নি ঋণগ্রহীতারা। এ সুবিধা গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধে অনাগ্রহী করে তোলে।

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার ৫০১ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২৩ দশমিক ০৪ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬৬ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৬ দশমিক ২০ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকের খেলাপি ২ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ এবং বিশেষায়িত তিনটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। এ অঙ্ক তাদের বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ

এ পরিস্থিতিতে গত জুলাইয়ে নতুন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার দায়িত্বে আসার পর খেলাপিদের বড় ধরনের ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণসংক্রান্ত নীতিমালা হালনাগাদ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

নতুন নীতিমালায় আড়াই থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া হয়। আগে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ডাউনপেমেন্টের অর্থ জমা দিতে হতো। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ পাঁচ থেকে আট বছরে পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হয়। আগে এসব ঋণ শোধ করতে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেওয়া হতো। এছাড়া নীতিমালায় খেলাপি হলেও নতুন করে ঋণ পাওয়ার কথাও বলা হয়।

এসব কারণে ঋণ শোধ না করে খেলাপিরা বিশেষ ছাড়ের অপেক্ষায় আছেন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

খেলাপি কমাতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল তা ঠিক ছিল না বলেই খেলাপি ঋণ কমছে বলে মন্তব্য করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, একের পর এক ছাড় দিয়ে আসলে ঋণ আদায় করা যাবে না। সিদ্ধান্ত নিতে হবে ভেবেচিন্তে। আগে বুঝতে হবে কোন কোন সমস্যার জন্য খেলাপি ঋণ আদায় হচ্ছে না। আর এ বিষয়গুলো যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানে না তাও নয়। তারা অবশ্যই জানে, শুধু পদক্ষেপ নিতে হবে।

এখন নতুন ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ভালো করে যাচাই-বাছাই করে দিতে হবে। এক খাতের ঋণ অন্য খাতে যাচ্ছে কি না এটা নিশ্চিত হতে হবে। শুধু কিছু ডাউনপেমেন্ট দিয়ে খেলাপি নিয়মিত করার সুযোগ দিলে খেলাপি ঋণ কমবে না। তবে যাদের সমস্যা আছে তাদের বিষয়ে ‘ম্যান টু ম্যান’ জেনে পদক্ষেপ নিতে হবে। ঢালাওভাবে সুবিধা দেওয়া যাবে না ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ খেলাপি আদায়ে সরাসরি ‘অ্যাকশনে’ যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, এখন যারা ঋণ পরিশোধ করছে না তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি অ্যাকশনে যেতে হবে। এর সঙ্গে কোনো ব্যাংকার বা ব্যাংকের পরিচালক জড়িত আছে কি না, তা দেখে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করলেই ঋণ পরিশোধ শুরু হয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।

সাবেক এ গভর্নর বলেন, এখন নতুন ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ভালো করে যাচাই-বাছাই করে দিতে হবে। এক খাতের ঋণ অন্য খাতে যাচ্ছে কি না এটা নিশ্চিত হতে হবে। শুধু কিছু ডাউনপেমেন্ট দিয়ে খেলাপি নিয়মিত করার সুযোগ দিলে খেলাপি ঋণ কমবে না। তবে যাদের সমস্যা আছে তাদের বিষয়ে ‘ম্যান টু ম্যান’ জেনে পদক্ষেপ নিতে হবে। ঢালাওভাবে সুবিধা দেওয়া যাবে না।

সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ২৩ শতাংশ!

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার ৫০১ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২৩ দশমিক ০৪ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬৬ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৬ দশমিক ২০ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকের খেলাপি ২ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ এবং বিশেষায়িত তিনটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। এ অংক তাদের বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ।

এদিকে দেশের ব্যাংক খাতে লাগামহীন খেলাপি বাড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার বিষয়ে সপ্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে সংস্থাটির প্রতিনিধি দলের সদস্যরা এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

আইএমএফের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয় কেন খেলাপি বাড়ছে? খেলাপি কমাতে কী উদ্যোগ বা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে? খেলাপিদের শাস্তির আওতায় আনা যাচ্ছে কি না? এসময় ব্যাংকিং খাতে সুশাসন (বাসেল-ত্রি), খেলাপি ঋণ সংজ্ঞায়ন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাব পদ্ধতি আন্তর্জাতিক মানদÐ অনুযায়ী করার তাগিদ দেয় আইএমএফ।

আসলে খেলাপি ঋণ কত?

ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ আসলে কত, তা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে খেলাপি ঋণ এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। এর বাইরে অবলোপন করা খেলাপি ঋণ রয়েছে আরও প্রায় অর্ধ লাখ কোটি টাকা। এছাড়া উচ্চ আদালতে রিট করে অনেক ঋণ নিয়মিত করে রাখা হয়েছে। ফলে আসলে কত টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে তার সুনির্দিষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্য তথ্য নেই।

বিশ্লেষকরা বলছেন ব্যাংক খাতের সঠিক হিসাব করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ আড়াই থেকে পৌনে ৩ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

স্ব.বা/বা

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *