তানোর উপজেলা হাসপাতাল আকুন্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত

রাজশাহী লীড
তানোর প্রতিনিধি: রাজশাহীর তানোর উপজেলা হাসপাতাল অনিয়ম ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিনত হয়ে আকুন্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে, এখন হাসপাতালেরই চিকিৎসা দেবার প্রয়োজন হয়ে উঠেছে।
জানা গেছে, নানা অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়েই চলছে  তানোর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা সেবা। এখানে এক্স-রে মেশিন তালবদ্ধ আর আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন বিকল বছরের পর বছর। সেইসঙ্গে রয়েছে নানা সংকটও।একদিকে নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক, অন্যদিকে যারা আছেন তাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে দায়িত্বহীনতার অভিযোগ। এখানকার আয়া-কর্মচারীরাই যতটুকু সম্ভব চিকিৎসা দিচ্ছেন। বর্তমানে করোনা ভাইরাসের দোহাই দিয়ে সার্বক্ষণিক অবস্থানের বিপরীতে মাত্র দুই থেকে আড়াই ঘন্টা দায়িত্ব পালন করেন এখানকার চিকিৎসক। ফলে এ উপজেলার প্রায় ৫ লাখ মানুষের স্বাস্থ্য সেবা ভেঙ্গে পড়েছে।গতকাল সরেজমিন, তানোর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঘুরে দেখা গেছে, ইমারজেন্সি বিভাগে নানা অব্যবস্থাপনার চিত্র। এখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক ওষুধ কোম্পানীর রিপেজন্টেটিভের সঙ্গে আলাপ চারিতায় ব্যস্ত। কিন্তু বাইরে রোগীরা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। সেদিকে কোন ভ্রপক্ষেপ নেই চিকিৎসকের। এখানে দেখে বোঝার উপায় নাই কে চিকিৎসক, কে কোম্পানীর লোক, কে রোগী ধরা দালাল সব মিলেমিশে একাকার।শুধু তাই নয়, হাসপাতাল থেকে রোগীর শুধু ব্যবস্থাপত্র দেয়া হচ্ছে। কোন ওষুধ কিংবা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়া হয় না। এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তানোর মহল্লার নূর হোসেন বলেন, আজ সকালে তার হাত কেটে যায়। পড়ে স্বজনরা তাকে হাসপাতালের ইমারজেন্সি বিভাগে নেয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক ওষুধ কোম্পানীর রিপেজন্টেটিভের সাথে আলাপ চারিতায় ব্যস্ত। আর রিপেজন্টেটিভ ওষুধের স্যাম্পুল উপঢৌকন নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কিন্তু বাইরে মেঝেতে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন রোগী। সেদিকে কোন ভ্রপক্ষেপ নেই ওই চিকিৎসকের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দোতলায় ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা এক ভুক্তভোগির পরিবার জানান, হাসপাতালের রোগীর বিছানায় ব্যবহৃত চাদর ও বালিসের কভারগুলো ময়লাযুক্ত দূর্গন্ধেভরা। রোগীর খাবার অত্যান্ত নিম্নমানের। ওয়ার্ড নার্সরা কক্ষ বন্ধ ভিতরে থাকেন। প্রয়োজনে রোগীর অভিভাবকরা নার্সদের ডাকলেও ভেতর থেকে কোন আওয়াজ আসে না। এছাড়া হাসপাতাল থেকে সরকারি ওষুধ আর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা রোগীদের দেয়া হয় না। এসব অভিযোগ বিষয়ে হাসপাতালের আয়া, নার্স, স্টোরকিপার ও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের নাম পরিচয় জানাতে অপরগতা প্রকাশ করেছেন টিএইচও ডাক্তার বার্নাবাস হাসদাক।
স্থানীয়রা জানান, মেডিকেলের হেড ক্লার্ক নূরুন নবী শাহীন দীর্ঘদিন ধরে এখানে চাকরি করায় বিভিন্ন অনিয়ম ও ঘুষ বাণিজ্যে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন তিনি। মূলত এখানে সম্প্রতি যোগদানকৃত টিএইচও’র তেমন কোন নজরদারি না থাকায় এপরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া হাসপাতালটিতে বেপরোয়া মেডিকেল সার্টিফিকেট ব্যবসা রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। হাসপাতালের ওয়ার্ডের প্রবেশাভিমুখেই রোগীর স্বজনদের মূত্র ত্যাগ করাসহ ওয়ার্ডের ভিতরে বিড়াল ও কুকুর ঘুরে প্রায় দিন। এদিকে, রোগী আর স্বজনদের দাবি হাসপাতালে স্বচ্ছ টয়লেট কিংবা গোসলখানাও নেই। যেসব টয়লেটগুলো রয়েছে দূর্গন্ধযুক্ত হওয়ায় ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এছাড়াও হাসপাতালের দেয়া নিম্নমাণের খাবার কোনো রোগী খায় না। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক আয়া জানান, সন্ধ্যার পরে অন্ধকার নেমে আসে। তখন বিদ্যুৎ চলে গেলে জুরুরি বিভাগের জন্য হারিকেন বাতির ব্যবস্থা করা হয় না। রোগীরা তাদের নিজ দায়িত্বে আলো বাতি নিজেরাই বহন করবে। তাদের মধ্যে অনেকেই মোমবাতির ব্যবস্থা করেন। মূলতো একটিমাত্র জেনারেটর থাকলেও তেলের অভাবে বন্ধ থাকে বলেই এসব দূর্দশা।
তথ্যনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারি এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের শুধু এমনই বেহাল চিত্র নয়। এখানে ২০ জন ডাক্তারের মধ্যে ৫ জনই রয়েছেন ডেপুটিশনে। বাকিদের ৪ জন ঢিমেঢালা অফিস করলেও ১১ জন ডাক্তার বাসায় বসে মাস শেষে বেতন তুলছেন।অপরদিকে, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৫ জন নার্সের পোষ্টিং থাকলেও নিয়মিত অফিস করেন ৭ জন। সেইসঙ্গে হাসপাতালের সরকারি ওষুধ বিক্রি করা স্টোর কিপারের পুরোনা অভ্যাস বলে অনেক রোগী ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।একই চিত্র উপজেলার ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও কমিউনিটিগুলোতেও রয়েছে বলে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, ডাক্তাররা জেলা শহর থেকে এসে দুই থেকে তিন ঘন্টা অফিস করেন। ফলে এ অঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষের চিকিৎসা সেবা হুমকির মুখে পড়েছে। এখানে একটি পূর্ণাঙ্গ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ৫টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রর পাশাপাশি পুরো উপজেলায় ১৭টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। সম্প্রতি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে প্রয়োজনের তুলনায় জনবলের পোষ্টিংয়ের কমতি না থাকলেও তারা কর্মস্থলে না থাকায় চিকিৎসা নিতে এসে বিপাকে পড়ছেন চিকিৎসার্থীরা। সরেজমিন দেখা গেছে, করোনাকালেও আউট ডোরের করিডোর থেকে চিকিৎসকের চেম্বার পর্যন্ত অনেক মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। তিনটি কক্ষের মধ্যে দুইজন ডাক্তার একটি কক্ষে বসে আছেন। এরমধ্যে বাকি দুই কক্ষে ডাক্তারের অপেক্ষায় রোগিরা ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু ডাক্তারা তাদের চিকিৎসার চেম্বার খুলে রেখে বিভিন্ন চায়ের দোকানে ও অফিসের বিভিন্ন কক্ষে বসে আড্ডা ঠুকছিলেন। সরকারি নীতি অনুয়ায়ী যেখানে ২০ জন ডাক্তার থাকার কথা, সেখানে আছে মাত্র ৭ জন। তবে, মেডিক্যাল টেকনোলজিষ্ট পদে ৩ জনের স্থলে ১ জন নামে মাত্র অফিস করেন। উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যনুযায়ী, মেডিক্যাল বিশেষজ্ঞ, গাইনি বিশেষজ্ঞ, জুনিয়র কনসালট্যান্ট, ডেন্টাল সার্জনসহ ৯৫টি পদের পোষ্টিং থাকলেও বাস্তরে ঢিমেঢালা অফিস করেন হাতেগুনা কয়েকজন। বাকিরা ক্ষমতার দাপটে বাসায় বসে বেতন-ভাতা উত্তোলন করেন।এদিকে, প্রায় তিন কোটি টাকা বরাদ্দের ৫০ শয্যা বিশিষ্ট নতুন ভবনের কাজ সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার সাড়ে তিন বছরেও শেষ করতে পারেননি। যতটুকু হয়েছে তাতে নানা অনিয়ম। এছাড়া হাসপাতালের মেইন গেটের দরজা বহু আগেই চুরি হয়ে গেছে। ফলে হাসপাতালটির আবাসিক এলাকায় গরু-ছাগল চরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এই জরাজীর্ণ হাসপাতালটির সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য ফুলের বাগান তৈরি বাবদ সরকার প্রতিবছর লাখ লাখ টাকা বরাদ্দ দিলেও হাসপাতালের টিএইচও আর আরএমও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের সাথে যোগসাজশ করে ফুলের বাগানের নামে বরাদদকৃত ওই অর্থ আত্নসাৎ করেই চলেছেন। এসব দেখার যেন কেউ নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন ভবন নির্মাণ কাজ শেষ না হলেও সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য বিভাগ নতুন ভবনের জন্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র সরবরাহ করেছে। সরবরাহকৃত আসবাবপত্র ব্যবহার না করায় দীর্ঘদিন ধরে ফেলে রাখায় সেগুলো নষ্ট হতে বসেছে।এব্যাপারে তানোর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (টিএইচও) ডাক্তার বার্নাবাস হাসদাক বলেছেন, আমি সম্প্রতি যোগদানের বহুআগে থেকে এক্স-রে মেশিন তালবদ্ধ আর আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন বিকল হয়ে আছে। আর অপারেশন থিয়েটার, ব্লাডব্যাংক ও ওষুধ স্টোর ছাড়াও চিকিৎসা ব্যবস্থা কি অবস্থায় তা এ মুহুর্তে বলা সম্ভব নয় বলে এড়িয়ে তথ্য প্রদানে অসম্মতি জানান ডা. বার্নাবাস হাসদাক।
Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *