স্বদেশ বাণী ডেস্ক: দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসাবে মনোনীত করা হয়েছে শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। তার নেতৃত্বে গঠিত হতে যাচ্ছে নতুন এই সরকার। এ সরকারের বাকি সদস্যদের নাম রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হবে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত ওই সরকার দায়িত্ব পালন করবে।
মঙ্গলবার রাতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধান ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৩ জন সমন্বয়কের চার ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বৈঠকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীমউদ্দীনও উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদীন ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সিদ্ধান্তের বিষয়টি মঙ্গলবার রাতে যুগান্তরকে নিশ্চিত করেন।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বাকি সদস্যদের নাম চূড়ান্ত করা হবে। এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্তের আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব পালনের বিষয়ে গণমাধ্যমে তার সম্মতি জানান।
এর আগে মঙ্গলবার দুপুরে রাষ্ট্রপতি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন। বঙ্গভবন থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করার তথ্য জানানো হয়। একইদিন আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ আরেক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদের অধীন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে সংসদ গঠনের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় তা বিলুপ্ত হলো।
সংসদ ভেঙে দেওয়ার এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। মঙ্গলবার বিকাল ৩টার মধ্যেই সংসদ ভেঙে দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন তারা। ওই আলটিমেটাম শেষ হওয়ার কিছু সময়ের মধ্যে আসে সংসদ বিলুপ্তির ঘোষণা।
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়ে গ্রেফতার শিক্ষার্থী ও রাজনীতিবিদদের মুক্তি দেওয়া শুরু হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দণ্ডাদেশ মওকুফ করে নির্বাহী আদেশ জারি করা হয়েছে। সাড়ে ৬ বছর পর মুক্ত হয়েছেন খালেদা জিয়। পাশাপাশি একইদিনে বিএনপি-জামায়াতের দুই হাজার দুইশ’র বেশি নেতাকর্মীর জামিন হয়েছে।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত রোববার দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। পদত্যাগের পর তিনি ও তার বোন শেখ রেহানা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত পালিয়ে যান। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অন্য মন্ত্রীরা পদত্যাগ করেছেন বলে গণ্য হয়। অর্থাৎ রোববারই মন্ত্রিসভা বিলুপ্ত হয়েছে।
ওইদিনই আওয়ামী লীগ ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। ওই বৈঠকে সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সংসদ ভেঙে দেওয়া হলো। ছাত্র আন্দোলনের সময়ে গ্রেফতার ব্যক্তিদের জামিন দেওয়া শুরু হয়েছে। পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনও করা হচ্ছে।
ওই বৈঠকের বিষয়ে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন জানান, বঙ্গভবনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা নিয়ে তিন বাহিনীর প্রধান ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের বৈঠকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান হিসাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাব করা হয়। রাষ্ট্রপ্রধান সাহাবুদ্দিন এই প্রস্তাবে সম্মতি দেন। রাষ্ট্রপতি বলেন, দেশ একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে।
এ সমস্যার সমাধানে যত দ্রুত সম্ভব অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে সমস্যার সমাধান দরকার। তিনি এ সংকটকালীন সমস্যার সমাধানে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্য উপদেষ্টাদের নাম চূড়ান্ত করা হবে। বীর মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রপতি এ সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেন।
বৈঠকের পর বঙ্গভবনের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাব করেছিলাম। রাষ্ট্রপতি ওই প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছেন। তাকে প্রধান করে দ্রুত সময়ের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে।
তিনি বলেন, আমরা ১০-১৫ জনের বেশি নামের প্রাথমিক তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে দিয়েছি, যেখানে নাগরিক সমাজসহ ছাত্র প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। এই তালিকা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে এটা চূড়ান্ত করা হবে ও খুব দ্রুত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চূড়ান্ত করা হবে। তালিকা যেহেতু চূড়ান্ত হয়নি, তাই এখনি সেটা প্রকাশ করা হবে না। তিনি আরও বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি ও তিন বাহিনীর প্রধানরা অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-নাগরিকদের সম্মান জানানোর পাশাপাশি অরাজকতা ও সহিংসতায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীমউদ্দীন খান উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৩ জন সমন্বয়ক-আরিফ সোহেল, সারজিস আলম, নাজিফা জান্নাত, নুসরাত তাবাসসুম, খান তালাত মাহমুদ রাফি, আবু সাদিক, ইভান তাহসির, আসিফ মাহমুদ, মো. নাহিদ ইসলাম, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী, মাহফুজ আলম, আবুবকর মজুমদার ও হাসনাত আবদুল্লাহ অংশ নেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জীবনী : ড. মুহাম্মদ ইউনূস সামাজিক উদ্যোক্তা, ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ এবং সুশীল সমাজের নেতা হিসাবে সারা বিশ্বে পরিচিত। গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ও ক্ষুদ্রঋণ ও ক্ষুদ্রবিত্ত ধারণার প্রবর্তনের জন্য ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন।
তিনি বেশ কয়েকটি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সম্মান পেয়েছেন। ২০১২ সালে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো ক্যালেডোনিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হন। এই পদে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন। তিনি তার অর্থনৈতিক কাজের ওপর ভিত্তি করে বেশ কয়েকটি বই প্রকাশ করেছেন। ইউনূস ১৯৯৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের কার্যক্রমকে সমর্থনকারী জনহিতকর সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস ফাউন্ডেশনের পরিচালনা পর্ষদে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ড. ইউনূস জাতীয় ও আন্তর্জাতিকসহ ১৪৫টি পুরস্কার অর্জন করেন।
মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৪০ সালের ২৮ জুন ব্রিটিশ-ভারতের বাংলা প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশ) চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব কাটে গ্রামে। তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পূর্ব পাকিস্তানের ৩৯ হাজার ছাত্রের মধ্যে ১৬তম স্থান অধিকার করেন। যখন ইউনূস চট্টগ্রাম কলেজে পড়াশোনা করছিলেন, তখন তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হন।
১৯৫৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৬০ সালে বিএ এবং ১৯৬১ সালে এমএ সম্পন্ন করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন। এরপর তিনি ব্যুরো অব ইকোনমিক্সে গবেষণা সহকারী হিসাবে যোগদান করেন। পরবর্তীকালে ১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম কলেজে প্রভাষক পদে যোগদান করেন।
১৯৬৫ সালে তিনি ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৯৬৯ সালে অর্থনীতিতে পিএইচডি লাভ করেন। ইউনূস বাংলাদেশে ফিরে আসার আগে ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের পক্ষে বিদেশে জনমত গড়ে তোলা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা প্রদানের জন্য সাংগঠনিক কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন এবং বিভাগের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন এবং ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এ পদে কর্মরত ছিলেন।
ইউনূস দরিদ্রতার বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম শুরু করেন ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত দুর্ভিক্ষের সময়। ওই সময় তেভাগা খামার প্রতিষ্ঠা করেন যা সরকার প্যাকেজ প্রোগ্রামের আওতায় অধিগ্রহণ করে। তিনি ১৯৯৬ সালে সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন গরিব বাংলাদেশিদের মধ্যে ঋণ দেওয়ার জন্য। মুহাম্মদ ইউনূস ও তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসাবে এই পুরস্কার লাভ করেন।