রাজশাহীতে ড্রেনের বিষাক্ত পানি দিয়েই চলে সবজি চাষ!

কৃষি বিশেষ সংবাদ লীড

স্টাফ রিপোর্টার: প্রতিদিন ভোরবেলা রাজশাহী নগরীর বিভিন্ন বাজারে তরতাজা শাক সবজি দেখা যায়। সবুজ সতেজ এই সবজি দেখে কিনতে ইচ্ছে হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই সবজি কতটা স্বাস্থ্যসম্মত ? আমরা অনেকেই জানিনা কিভাবে সতেজ করা হয়েছে এসব সবজি।

খোঁজ নিতে গিয়ে তথ্য মিলেছে রাজশাহী শহরের বাজারগুলোতে প্রতিদিন যে শাক সবজি পাওয়া যাচ্ছে তার একটি অংশ আসছে নগরীর ড্রেনের পাশ থেকে। মুলত ড্রেনের পানি দিয়ে এসব সবজি চাষ করা হয়েছে। নগরীজুড়ে ড্রেনের পাশে যেসব জমি রয়েছে সেগুলোতে ব্যাপক হারে সবজি চাষ হচ্ছে।

রাজশাহী নগরী ও পবা এলাকায় সবজির জমিতে ব্যাপকহারে ড্রেনের এসব বিষাক্ত পানি ব্যবহার করা হচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তবে, এগুলো বন্ধে করোরই কোন উদ্যোগ নেই।

রাজশাহী নগরের প্রতিদিনকার ব্যবহৃত পানি আঁকা বাঁকা হয়ে ড্রেন দিয়ে গিয়ে পড়ছে বারনই নদীতে। ড্রেনের পাশে যাদের জমি রয়েছে তারা ড্রেনে স্যালো মেশিন বসিয়ে সামান্য খরচেই জমিতে সেচ দেয়া যায়। যাদের জমির পরিমান কম তারা বালতিতে করে ড্রেনের পানি তুলেই করতে পারেন চাষাবাদ। আবার এসব জমির মালিকরা বলছেন, এই পানি ফসলে দিলে নাকি সারের তেমন একটা দরকার হয়না। একারণে অনেকটা উৎপাদন খরচ কম হয়। অন্যদিকে শাক সবজি দেখতেও হয় অনেক বেশি তরতাজা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, রাজশাহী শহরের মালদা কলোনী থেকে শুরু করে বারনই নদীর পাশে বিলে গিয়ে ড্রেন থেমেছে। আর বিল থেকে পানি গিয়ে পড়ছে নদীতে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন রাজশাহীর ড্রেনের পানিতে হাসাপাতাল, ক্লিনিকের বর্জ্য, রাস্তাঘাটের প্রতিদিনকার আবর্জনা, কলকারখানার বর্জ্য ও মানুষের বর্জ্য রয়েছে। রাজশাহী নগরীর পশ্চিম পাশ দিয়ে কোর্ট স্টেশন, বর্ণালী, সিলিন্দা ও পাকুড়িয়া এলাকা হয়ে বর্জ্য পানি বের হয়ে পবা উপজেলার হড়গ্রাম ইউনিয়নের ভেতর দিয়ে দুয়ারী স্লুইস গেটে দিয়ে পবার বারনই নদীতে পড়ে। নগরের পুর্ব পাশ দিয়ে অনুরূপ একটি নালার বর্জ্য পানি পবা উপজেলা নওহাটা পৌর এলাকার হঠাৎপাড়া স্লুইস গেট দিয়ে বারনই নদীতে গিয়ে পড়ে।

এই ড্রেনে দেখা গেলো মরা মুরগী, অপারেশনের ব্যবহৃত ময়লা, রক্ত, মানব বর্জ্য। আছে পলিথিন ও প্লাস্টিকের স্তুপ। এসব ড্রেনের পাশে দিয়ে গেলে নাক চেপে না ধরা পর্যন্ত টেকা দায়। অনেক জায়গায় গন্ধে দম বন্ধ হবার অবস্থা। পানি পচে কালচে রং ধারণ করেছে। এসব পানি দিয়েই চলছে জমি চাষ। স্থানীয়রা জানায়, ড্রেনের পানি দিয়ে ধান, হলুদ,পাট, টমেটো, রশুন, পিঁয়াজ, ধনে পাতা, ফুল কপি, বাঁধা কপি, আলু, বেগুন, কাঁচা মরিচ, সরিষা, বিভিন্ন ধরনের শাক সবজি, মুলা, ঢেঁঢ়শ, কাকরোল, বরবটি সব ধরনের ফসলেরই আবাদ হয়। এসব জমি কখনোই ফাঁকা থাকেনা। বরং সারা বছরজুড়েই নানান ফসল চাষ হয়।

বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেলো, ড্রেনে মেশিন দিয়ে জমিতে পানি নিয়ে যাচ্ছে কৃষকরা। লম্বা পাইপ লাগিয়ে অনেক দূর পর্যন্তই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পানি। অনেক সময় তারা পানি নিতে ব্যবহার করছেন গজ ফিতা পাইপও। সিটি হাট এলাকায় জমিতে পানি দিচ্ছিলেন আতাউর আলী। তিনি সাহেব-বাজার টোয়েন্টিফারকে বলেন, আমার ও পরিবারে ৫ বিঘা জমি আছে ড্রেন পাড়ে। এসব জমির জন্য তারা সবসময়ই ব্যবহার করেন ড্রেনের পানি। তিনি বলেন, ড্রেনের পানিতে ভালো ফলন হয়। তাই এটি ব্যবহার করি।

আরেক কৃষক শহিদুল ইসলাম পানি দিচ্ছেন পুঁই শাকের জমিতে। তিনি বলেন, এই পানি ব্যবহারে আমাদের ফসল বেশি হয়। অনেক সময় পানির কারণে আমাদের সার ও কিটনাশকও কম দিতে হয়। এজন্য এটি আমরা ব্যবহার করে থাকি। এই খালের পানিতে আবাদ ভালো হয়। কিন্তু গায়ে লাগলে গা চুলকে ছিঁড়ে যায়। এই একটু অসুবিধা। শহিদুল বললেন, ভবিষ্যতে জমির ক্ষতি হতে পারে তবে এখন ফসল ভালোই হচ্ছে। কিন্তু এসব সবজি কতটা স্বাস্থ্যকর কেউ জানেন কি ?

রাজশাহী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান খান বাদশা বলেন, রাজশাহীতে সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্যের সঙ্গে কলকারখানার বর্জ্য এই নালায় যাচ্ছে। কারখানাগুলোতে নিয়ম অনুযায়ী বর্জ্য পরিশোধনের জন্য ইটিপি (ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট পান্ট) থাকার কথা। তা না থাকার জন্য এই রাসায়নিক বর্জ্যের সঙ্গে ভারী ধাতুও যাচ্ছে। যা থেকে ক্যান্সার ও অন্যান্য মারাক্তক রোগ ছড়াতে পারে। এটির মাধ্যমে কিডনির রোগ হতে পারে। আর্সেনিক জনিত রোগেরও আশংকা থাকে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এম. মঞ্জুর হোসেন বলেন, এভাবে জমি চাষ করলে কয়েক ধরনের ক্ষতি হয়। প্রথমত এভাবে উৎপাদিত খাবার মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর, দ্বিতীয়ত এভাবে জমি চাষ করলে ঐ জমির উৎপাদন ক্ষমতাও নষ্ট হয়। আবার যারা এই পানি ব্যবহার করছেন তাদেরও ক্ষতি হচ্ছে। এটি মারাত্মক ক্ষতি করে। এজন্য এটি প্রশাসনের নজরে আনা দরকার। যাতে করে মাটি ও মানব স্বাস্থ্য রক্ষা পাবে।

তিনি বলেন, বর্জ্য পানিতে চাষ করা সবজিতে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে। এই পানিতে হাসপাতাল, ক্লিনিকের বর্জ্য ফেলা হয়, যা পুড়িয়ে ফেলার কথা। সেই সঙ্গে মানুষের বর্জ্যও গিয়ে মিশছে। এতে ভয়ঙ্কর সব ব্যাকটেরিয়া থাকে যার ভেতরে মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর সব রোগ জীবাণু থাকে।

এবিষয়ে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক সামসুল ইসলাম বলেন, এটি আমরা জানি। চাষিদের সচেতন করা হচ্ছে। তবে এর বিরুদ্ধে কোন আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। কারণ কোন পানি ব্যবহার করতে হবে আইনে তা নির্দিষ্ট করে বলা নেই। তবে সতেচন করা হচ্ছে। এখন তারা না মানলে তো আর কিছু করার থাকে না।

রাজশাহীর জেলা প্রশাসক হামিদুল হক বলেন, বিষয়টি নিয়ে তিনি কৃষি বিভাগের সাথে কথা বলবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন।সূত্র: সাহেব-বাজার টোয়েন্টিফোর।

স্ব.বা/শা

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *