ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যানালগ অনিয়ম

লীড শিক্ষা

স্বদেশবাণী ডেস্ক: নতুন প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটিতে (বিডিইউ) বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। নিয়ন্ত্রিত দরপত্রের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ঢাকা ও কালিয়াকৈরে একাধিক ভবন ভাড়া করা হয়। পরে ভাড়া বাড়িতে স্থায়ী বা স্থানান্তর অযোগ্য পূর্ত কাজ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কাজ নির্দিষ্ট কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করা হয়েছে।

আবার রহস্যজনক কারণে বেশকিছু কাজে একটিমাত্র প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে অংশ নিয়েছে। এসব দরপত্রের বাজেট নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শিক্ষা বিভাগে নিয়োগ করা হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) বিষয়ে পাশ করা দুই প্রার্থীকে। এ নিয়ে উচ্চ আদালতে বঞ্চিত দুই প্রার্থী রিট করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে প্রায় ৬ কোটি টাকার একটি কেনাকাটার প্রক্রিয়া চলছে। ওই ক্ষেত্রেও সিন্ডিকেটের পূর্বানুমোদন নেয়া হয়নি।

গত বছরের ২৬ ও ২৭ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তিন সদস্যের দল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট নিরীক্ষা করে। দলটি ২০টি অনিয়ম চিহ্নিত করার পাশাপাশি ব্যয়ের ওপর আপত্তি দেয়। ওই দলের নেতৃত্ব দেন সংস্থাটির সিনিয়র সহকারী পরিচালক হাফিজুর রহমান। তিনি ৪ এপ্রিল যুগান্তরকে বলেন, সরকারের রাজস্ব বরাদ্দের ব্যয়ের ওপর নিরীক্ষা করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে যেসব অনিয়ম বা পর্যবেক্ষণ আছে তা আমরা বিশ্ববিদ্যালয়টিকে জানিয়ে দিয়েছি। প্রক্রিয়া অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় এখন আপত্তি সংশোধন করে ইউজিসিকে জানাবে। তা না করলে আপত্তিগুলো পরিপত্র আকারে জারি করার বিধান আছে।

বাড়ি ভাড়ায় আপত্তি : বিডিইউ ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি ঢাকা ও গাজীপুরের কালিয়াকৈরে কয়েকটি ভাড়া ভবনে পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, এ প্রতিষ্ঠানের প্রথম দরপত্র ছিল রাজধানীতে নগর ক্যাম্পাসের বাড়ি ভাড়াসংক্রান্ত। কোনো প্রতিযোগিতা ছাড়া মাত্র একটি দরপত্রের মাধ্যমে ২৪০৮ বর্গফুটের ফ্ল্যাট মাসে ৯০ হাজার ৪৭৫ টাকায় ভাড়া নেওয়া হয়। পরে একই ভবনে পাশাপাশি আরেকটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে গেস্ট হাউজ করা হয়। একইভাবে কালিয়াকৈরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের জন্য একই কৌশলে দুটি ভবন ভাড়া করা হয়। ওই কর্মকর্তা জানান, ১০ লাখ টাকায় কালিয়াকৈরের মতো স্থানে যে পরিমাণ জায়গা ভাড়া করা হয়েছে, তা স্থানীয় মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। বাড়ির কাজ কবে সম্পন্ন হয়েছে, কবে থেকে ভাড়া পরিশোধ শুরু হয় আর বাস্তবে একইমানের বাড়ির ভাড়া কেমন- তা তদন্ত করলে অনেক দুর্নীতি বেরিয়ে আসবে।

সূত্রমতে, বিধান না থাকলেও ওইসব ভাড়া বাড়ির কোনো কোনোটিতে টাইলস ও ইলেকট্রিক লাইন লাগানো, প্লাস্টার করা, দেয়াল তৈরির মতো স্থায়ী অবকাঠামোগত উন্নয়নে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। অথচ এসব কাজ বাড়ির মালিকেরই করার কথা। এ ছাড়া ডেকোরেশনও করা হয়েছে। সূত্র জানায়, গাজীপুরের কালিয়াকৈরে দুটি এবং ঢাকায় নগর ক্যাম্পাসের উল্লিখিত (সিভিল ও ইন্টেরিয়র) কাজে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি ব্যয় করা হয়। এ পরিমাণ অর্থে ওই এলাকায় একটি সম্পূর্ণ ভবন নির্মাণ সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

নিয়ন্ত্রিত দরের নমুনা : বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কিছু কাজ ও কেনাকাটা করা হয় নির্দিষ্ট কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এর মধ্যে রয়েছে মার্কস আর্কিটেকচার অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার, বিগএম রিসোর্সেস, ক্রিসেন্ট কম্পিউটার্স ও আইথ্রিসিক্সটি বাংলাদেশ লিমিডেট। দুটি তালিকায় দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় যেসব কাজ করিয়েছে তার মধ্যে মার্কস আর্কিটেকচার ৬ কোটি ৩৪ লাখ ৮১ হাজার টাকার ৫টি কাজ করেছে। ইউজিসি বলছে, একই প্রতিষ্ঠানকে ৫টি কাজ দেয়ায় স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠানটিকে ৩১ লাখ টাকার স্থায়ী ক্যাম্পাসের মাস্টার প্ল্যান, অ্যানিমেশনসহ থ্রিডি মাস্টার প্ল্যানসহ কিছু কাজ দেওয়া হয় ২০১৮-১৯ বর্ষে। কাজ বুঝে নিয়ে ৭০ শতাংশ বিল দেওয়া হয়। কিন্তু ডিপিপি তৈরির প্রাথমিক কার্যাদি সম্পন্নের দেড় বছর পার হওয়া সত্ত্বেও পরবর্তী কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এটি নিয়মের ব্যত্যয় ও রাজস্ব ক্ষতি।

জানা গেছে, আইথ্রিসিক্সটি বাংলাদেশ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে তিনটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ দেওয়া হয়েছে। এর দুটি বিগএম ও রাইট রিসোর্সেস। এগুলোর সঙ্গে আইথ্রিসিক্সটি অন্তত ৭টি কাজ যৌথভাবে করেছে। এ নিয়েও ইউজিসি প্রশ্ন তুলে বলছে, এতে স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মার্কস আর্কিটেকচার ইঞ্জিনিয়ারিং প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকার কাজ করলেও সেটির সঙ্গে আইথ্রিসিক্সটি বাংলাদেশ যৌথ কোনো কাজ কেন করেনি সে বিষয়ে মন্ত্রণালয় তদন্ত করলে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তর ব্যানবেইসের একটি সফটওয়্যার তৈরি করে দেওয়ার কাজ নেয় এ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রশ্ন উঠেছে, সফটওয়্যার তৈরিতে এত সক্ষম হলে বিশ্ববিদ্যালয়টি তার সব সফটওয়্যারই উল্লিখিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে কেন কিনছে! অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে তথ্যপ্রযুক্তির কাজের জন্য অন্তত ২০ জন কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। যদি বাইরে থেকে সফটওয়্যার কিনতে হবে, তাহলে এসব কর্মকর্তার কাজইবা কী?

খরচের নমুনা : সূত্র জানায়, তাপমাত্রা মাপা যন্ত্র প্রতিটি ৬ লাখ সাড়ে ৩ হাজার করে ১৮ লাখ ৯ হাজার টাকায় কেনা হয়। ৫৫ ইঞ্চি সনি টিভি ১ লাখ ৭৯ হাজার ৫৬০ টাকা, রিডিং টেবিল ১ লাখ ৩০ হাজার ৬০০ টাকা, খাট ৯৩ হাজার ৫৭৫ টাকা, রুম ক্লোজার ২৫ হাজার, দরজা ৫৬ হাজার, টিউবলাইট ২ হাজার ৯০ টাকা, মনিটর ৪২ ইঞ্চি ৭৭ হাজার ৬০৪ টাকা, ডিজিটাল ডোর লক ৮৭ হাজার ৪৭৭ টাকা, চেয়ার ৬৫ হাজার ৯১২ টাকা, ল্যাপটপ (ডেল ইন্সপাইরন কোর আই ৫) ৮০ হাজার ৪০ টাকা, কম্পিউটার (ডেক্সটপ ইন্টেল কোর আই সেভেন) ২ লাখ ৭৬ হাজার টাকা, পর্দা (৪৪৫৫/এসকিএম) ১ লাখ ৭৩ হাজার ২৭৫ টাকা (প্রতি রুম), প্লাস্টিকের স্প্রে কনটেইনার ১০ হাজার ৬১৫ টাকা, ফ্যান প্রতিটি ৩ হাজার ৩৯৯ টাকা। এ মূল্য বাজার দরের চেয়ে বহুগুণ বেশি। সংশ্লিষ্টরা তাই এ বিষয়েও তদন্ত দাবি করেছেন।

ইউজিসির ২০ আপত্তি : বিভিন্ন ধরনের কেনাকাটা ও বাড়ি ভাড়ায় অনিয়ম-অস্বচ্ছতা, উপাচার্যের গাড়ি ও মোবাইল ফোন ব্যবহার, সংস্কার কাজ, অবৈধভাবে জনবলকে ‘কোভিড প্রণোদনা’ প্রদান, খণ্ডকালীন শিক্ষককে একইভাবে যাতায়াত ভাতা দেয়া, ক্রয় করা মালের স্টক এন্ট্রি (হিসাব) না করা, ভ্যাট ও আয়কর আদায় না করা, বিল ছাড়াই ভাউচার করা, আউটসোর্সিংয়ে ব্যয় করা অর্থের বিপরীতে দেওয়া ভ্যাট বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে খরচ, অডিট সেল না রাখা ও প্রাক-নিরীক্ষা করার বিধান লঙ্ঘন, ভাউচারে টিআইএন ও বিআইএন না রাখা, সার্ভিস চার্জ আদায় না করা ইত্যাদি। সবমিলে প্রায় সোয়া ১০ কোটি টাকার অডিট আপত্তি দিয়েছে সংস্থাটি।

এ প্রসঙ্গে ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক মো. আবু তাহের শনিবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, আমাদের একটি টিম তদন্ত করে বেশকিছু আপত্তি দিয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠানকে কেন একাধিকবার কাজ দিতে হবে? দেশে কী কাজ করার প্রতিষ্ঠানের অভাব আছে? তাছাড়া একটি দরপত্রের মাধ্যমে বাড়ি ভাড়া নেয়া হয়েছে। ইউজিসি যে আপত্তি বিশ্ববিদ্যালয়টিকে দিয়েছে তা নিষ্পত্তি করতে হবে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। তিনি বলেন, আমি শুনেছি, সরকারি অডিটেও একই রকম আপত্তি এসেছে।

শিক্ষক নিয়োগ, হাইকোর্টে রিট : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। সে অনুযায়ী আবেদনও জমা নেওয়া হয়। কিন্তু শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত পূরণ না করা দুজনকে নিয়োগ দেয়া হয়। পরে ওই পদের শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত পরিবর্তন করা হয়। অথচ শিক্ষা বিভাগে নিয়োগ পাওয়া ওই দুই প্রভাষক শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত পূরণের লক্ষ্যে এখন মিরপুরে বেসরকারি প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয়ে (শিক্ষা বিভাগেই) লেখাপড়া করছেন। যুগান্তরকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা বিভাগের প্রধান আহমেদুল আজম। তিনি বলেন, ওই শিক্ষক প্রথমে এক বছর মেয়াদি বিএড করেন। এখন এমএডে পড়ছেন। এ ঘটনায় নিয়োগবঞ্চিত দুই প্রার্থী মো. সাব্বির হোসেন ও মো. জুলহাস আহমেদ উচ্চ আদালতে রিট করেন। সাব্বির জানান, ৯ মার্চ হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে শুনানি হয়েছে। হাইকোর্ট রুল জারি করেছেন। চার সপ্তাহের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে।

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : এ প্রসঙ্গে জানতে উপাচার্য অধ্যাপক মুনাজ আহমেদ নূরের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আশরাফ উদ্দিনের যুগান্তরকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী উপাচার্য। এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। তাই কোনো বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলাই শ্রেয়। তিনি বলেন, শিক্ষক নিয়োগ এবং বিভিন্ন ব্যয়সহ অর্থ সংশ্লিষ্ট কাজ বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। তবে তিনি স্বীকার করেন, কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ঘুরেফিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজ পেয়েছে। পাশাপাশি একটি প্রতিষ্ঠান অন্য কয়েকটির সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। মামলা চলমান থাকায় শিক্ষক নিয়োগ সম্পর্কে তিনি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *