গোপন রহস্য ফাঁসের ভয়েই পুরো পরিবারকে হত্যা!

আন্তর্জাতিক

স্বদেশবাণী ডেস্ক: বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত মেধাবী তরুণ মেনহাজ জামানকে তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য পরিবারের সদস্যরা তাকে একটা সোনার টুকরো ছেলে হিসাবেই বিবেচনা করত। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে তিনি এমন একটা গোপন বিষয়কে লুকিয়ে রেখেছিলেন, যা শেষ পর্যন্ত তাকে একজন হত্যাকারীতে পরিণত করে।

পড়াশোনা আর ক্যারিয়ারের জন্য মেনহাজ জামানের বাবা-মা তাদের ছেলের বিষয়ে বড়াই করতেই পছন্দ করতেন। তারা গর্বের সাথে সবাইকে বলতেন যে, তাদের ২৩ বছর বয়সী ছেলে তার পরিবারকে সর্বদা প্রাধান্য দিয়ে এসেছে এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নিয়ে স্নাতক হতে চলেছে। আর তার সামনে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে।

আর তাদের এসব কথা শুনে সামাজের চেনাজানা অপরাপর অভিভাবকরাও নিজেদের সন্তানদের জন্য এমন সরল-সোজা স্বভাব এবং নির্ভরযোগ্য হওয়ার জন্য দোয়া কামনা করতেন।

এদিকে, মেনহাজের বাবা মনিরুজ (৫৯) এবং মা মমতাজ (৫০) যেন ছেলের স্নাতক পাসের জন্য অপেক্ষা করতে পারছিলেন না এবং এতদিন ধরে সে যে কঠোর পরিশ্রম করেছেন তার ফল দেখতে অধীর ছিলেন।

মেনহাজ জামান অন্টারিওর মার্কহ্যামে তার বাবা-মা ছাড়াও তার ২১ বছর বয়সী বোন মালেসা ও ৭০ বছর বয়সী নানী ফিরোজা বেগমের সঙ্গে একত্রেই থাকতেন। তার বাবা-মা মূলত ভালো সুযোগ-সুবিধার সন্ধানে বাংলাদেশ থেকে কানাডায় চলে গিয়েছিলেন।

মনিরুজ সেখানে স্থানীয় ট্যাক্সি ব্যবসায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এবং পাশাপাশী তার স্ত্রী মমতাজও স্থানীয় সম্পত্তি ভাড়ার সাথে জড়িত হন। এতে বাবা-মা দুজনেই ব্যস্ত হয়ে পড়ায় মেনহাজ ও তার বোনের দেখাশোনার জন্য তার নানী ফিরোজা বেগমকে কানাডায় নিয়ে যাওয়া হয়।

কানাডায় নিজেদেকে প্রতিষ্ঠিত করলেও এই মনিরুজ-মমতাজ দম্পতি তাদের শিকড় নিয়ে গর্বিত ছিল এবং তারা তাদের ছেলে-মেয়েকে বাংলাদেশী ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়াটা নিশ্চিত করেন। তাদের শিক্ষার মূল অংশটি ছিল পরিবারের প্রতি গুরুত্ব এবং কাজের প্রতি শক্তিশালী নৈতিকতা। জামান ও মালেসাকে শৈশব থেকেই এটাই শেখানো হয় যে, শিক্ষা এবং কঠোর পরিশ্রমই সাফল্যের ভিত্তি।

এর মধ্যে ২০১৯ -এ মালেসা ছিলেন একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং তিনি নিউরোসার্জন হতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে এই সময়ে তার ভাই মেনহাজ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে তার মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনার কথা বলে প্রতিদিন বাড়ি থেকে বের হতেন এবং ফিরেও আসতেন। মেনহাজের পরিবারও ভাবত যে, সে প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়েই যাচ্ছে। এবং তারা তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে দম্ভও করত।

 

জামানের স্নাতক শেষ হওয়ার কথা ছিল গত ২৮ জুলাই। এবং তার পরে তার স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েও আলোচনা চলছিল। কিন্তু তার একটা গোপন রহস্য ছিল। সে বছরের পর বছর ধরে দ্বৈত জীবন যাপন করছিল এবং তার পড়াশোনায় গ্র্যাজুয়েশনের কোনও সম্ভাবনা ছিল না।

কারণ হিসেবে জানা যায় যে, জামান আদৌ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়নি। বরং সে একটা স্থানীয় কলেজের ভর্তি তালিকায় ছিল, তবে সেখানে সে ক্লাস করতেও ব্যর্থ হতো। তাদের পুনরাবৃত্তি করার সুযোগ দেওয়া সত্ত্বেও সে এখনও সফল হতে পারেনি এবং কয়েক সেমিস্টার বাদেই ২০১৫ সালের সে ঝরে পড়েছিল।

তবে সে তার পরিবারকে এ বিষয়ে কিছুই বলেনি। সে কেবল তার ব্যাকপ্যাক এবং ল্যাপটপটি নিয়ে প্রতিদিনই বাসা থেকে বের হতো এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে বলে বছরের পর বছর ধরে অব্যাহত একটি বিস্তৃত মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।

শুরুর দিকে জামান ক্যাম্পাসের দিকেই যেতো। তবে পরবর্তীতে কোথাও শান্তি খুঁজে না পেয়ে সে মাল্টিপ্লেয়ার রোল-প্লে ভিডিও গেমের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। তখনই সে বিশ্বজুড়ে অনলাইন বন্ধু বাগিয়ে নিজেকে ভার্চুয়াল জীবনের একজন অদৃশ্য বাসিন্দা বানিয়ে নেয়- যেখানে তার কোনও ব্যর্থতা ছিলো না।

কিছুদিন পরে, জামান একটি স্থানীয় শপিং মলে বা জিমে যাবার জন্য বায়না ধরে। এতে অবশ্য তার পরিবার কোনও কিছু সন্দেহ করেনি এবং বাড়িতে সন্দেহ প্রকাশ পায় এমন কোনও অনর্থক আচরণ সে করেনি।

২০১৯ সালের গ্রীষ্মের মধ্যে- সে বুঝতে পারে যে, সময় দ্রুতই ফুরিয়ে যাচ্ছে। তাঁর বাবা-মা তাঁর স্নাতকোত্তর অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছিলেন- এবং জামান ধরেই নিয়েছিল যে, তার গোপন রহস্য উন্মোচিত হতে চলেছে।

তিন বছর ধরে, সে তার বাবা-মায়ের মধ্যে বিষয়টি এড়ানোর জন্য এ সম্পর্কে একটি বিভ্রান্তিকর ধারণা জাগিয়ে রেখেছিল। কিন্তু এখন সময় এসেছে তার পরিকল্পনাটিকে কার্যকর করার।

২১ জুলাই ২০২০, তার স্নাতক শেষ হওয়ার আগের দিন জামানের বাবা তার কর্মস্থলেই ছিলেন। তার বোন একটি মুদি দোকানে তার খণ্ডকালীন চাকরিতে ছিলেন এবং তার মা এবং নানী ঘরেই শায়িত ছিলেন।

ওইদিন বেলা ৩টার দিকে, সে তার মাকে মারতে মারতেই মেরে ফেলে। তাকে একটা শাবল দিয়ে আঘাত করে এবং রান্নাঘরে থাকা ছুরি দিয়ে তার গলা কেটে খুন করে জামান। তার প্রায় এক ঘণ্টা পরে, সে তার নানীর ক্ষেত্রেও একই কাজ করে।

এই ঘটনার পর জামান কয়েক ঘণ্টা ধরে ভিডিও গেমস খেলে এবং তার বোনের বাড়িতে আসার অপেক্ষায় ছিল। মালেসা যখন দরজা দিয়ে হেঁটে ঘরে ঢুকলো, তখনই সে তার মাথায় আঘাত করল এবং গলাটিও কেটে ফেলল।

এটি ছিল মধ্যরাতের কাছাকাছি সময়ের ঘটনা। এর এক ঘণ্টা পরে, যখন তার বাবা কাজ থেকে ফিরে আসেন, জামান তার এই ঘৃণ্য কাজটি একইভাবে তার বাবার ওপর প্রয়োগ করে এবং তার গলা কেটে শেষ করে।

জামান তখন ৯১১ হেল্পলাইনে কল করা বা পালিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে তার পরিবারের সদস্যদের লাশ নিয়েই বাড়িতে অবস্থান করছিল এবং তার অনলাইন গেমিং বন্ধুদের সাথে কথা বলতে শুরু করে।

সে তাদেরকে লিখে জানায়, “আমি কেবল আমার পুরো পরিবারকে জবাই করেছি।” সে তাদেরকে আরও বলে যে, সে তাঁর বাকী জীবনটা কারাগারেই কাটাতে চায়। এতে প্রথমদিকে তারা ভেবেছিল যে, সে তাদের সঙ্গে রসিকতা করছে এবং এটি ভার্চুয়াল বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করার একটি টুইস্ট উপায়।

কিন্তু জামান যখন তার বাবা-মা-বোনের লাশের কয়েকটি ছবি কয়েক বন্ধুকে পাঠায় এবং একটি সেলফি তোলা রক্তাক্ত ছুরির হাতে রাখা ছবিও দেয়, তখন তারা মারাত্মকভাবে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে।

আর এরপরেই অনলাইন সম্প্রদায় যথাযথ কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করতে তোলপাড় সৃষ্টি করে এবং জামানকে গ্রেফতার করতে তৎপর হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে জামানের কানাডীয় অবস্থান এবং কেবল একটি মাত্র গেমিং ইউজার নেম থাকায় তাদের সুবিধা হয়।

শেষ পর্যন্ত জামানের আইপি ঠিকানা ট্র্যাক করা হয় এবং গত ২৮ জুলাই বিকেলে পুলিশ তার বাড়িতে উপস্থিত হন। তখনও জামান সেখানেই অবস্থান করছিল- এবং উপরে ছিল মমতাজ, মনিরুজ, ফিরোজা এবং মালেসার মরদেহ।

জামানকে তখনই গ্রেপ্তার করা হয় এবং প্রাথমিকভাবে তার উপর চারজনকে হত্যার প্রথম-স্তরের অভিযোগ আনা হয়। এই গণহত্যার ঘটনাটি সবাইকে হতবাক করে দেয় এবং জামান যে এই হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে- তা কেউই বিশ্বাস করতে পারছিল না। তার মতো এমন সোনার টুকরো ছেলে, যে কিনা তার মা’কে কেনাকাটায় সহায়তা করেত এবং তার প্রত্যাশামাফিক সবকিছুই করত। যে কিনা তার পুরো জীবনে কখনও সমস্যায় পড়েনি।

সে সময়েই জামান স্বীকার করে নেয় যে, সে তার পরিবারকে হত্যা করেছে। কারণ তারা জানতে পেরেছিল যে, সে তার শিক্ষার বিষয়ে বছরের পর বছর তাদেরকে মিথ্যা বলে এসেছে। সে চায়নি যে তারা তার জীবনের ব্যর্থতা নিয়ে এবং দ্বৈত জীবন নিয়ে জেনে ফেলুক।

সে আরও স্বীকার করে যে, সে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল এবং “সে তিন বছর ধরে এটার পরিকল্পনা করেছিল।”

বর্তমান অবস্থা
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে, জামান তার নানী, বাবা এবং বোনকে হত্যার জন্য প্রথম স্তরের হত্যাকারী হিসেবে এবং তার মা’কে হত্যার জন্য দ্বিতীয় স্তরের হত্যাকারী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত হয়। আদালতকে সে জানায় যে, সে তার পুরো পরিবারকে গলা কেটে হত্যা করেছে, কেবল তাদের থেকে সত্য কথাটি এড়াতে।

এর দুই মাস পরে জামান কোভিড-নিয়ন্ত্রিত ভার্চুয়াল কোর্ট রুমের মুখোমুখি হয়েছিল এবং তাকে কারাদণ্ড দেয়া হয়। সেখানে সে সংক্ষেপে কথা বলে যে, “আমি আমার কর্মের জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছি এবং আমি ক্ষমা চাই।”

বিশ্বাসের সাথে প্রতারণা
বিচারক প্রকাশ্যে তার কর্ম সম্পর্কে নিন্দা জানিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে, তিনি যা করেছেন তা “মারাত্মক উদ্বেগজনক” এবং কঠোর শাস্তির দাবিদার। বিচারক বলেন, “তার এই সহিংস প্রবণতাকে নৃশংস, নিষ্ঠুর, ঠাণ্ডা মাথার খুনি এবং নির্বোধের মতো শব্দগুলো দ্বারা প্রকাশযোগ্য নয়।”

বিচারক আরও বলেন, “ভুক্তভোগীর গলা কেটে ফেলার চেয়ে মানুষের জীবন নিয়ে নেওয়ার জন্য আরও ভয়াবহ উপায় কল্পনা করা কঠিন। কিন্তু মিঃ জামান এটা কেবল একবার নয়, কয়েক ঘণ্টা ধরে আলাদা আলাদা চারবার করেছেন।

বিচারক আরও যোগ করেছেন যে, এটি একটি “বিশ্বাসের সাথে প্রতারণা” ছিল, যা পরিবারের সদস্যদের প্রতি সংঘটিত হয়েছিল। যেখানে কিনা প্রত্যেককে নিরাপদ বোধ করা উচিত।

এই ঘটনায় বর্তমানে ২৪ বছর বয়সী মেনহাজ জামানকে ৪০ বছরের জন্য (প্যারোলে থাকার সম্ভাবনাহীন) কারাগারে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দণ্ডিত হয়েছিল, যার অর্থ- স্বাধীনতার স্বাদ নেওয়ার সুযোগ পাওয়ার আগেই সে ৬৪ বছর বয়সী হয়ে যাবে।

মূলত তরুণ জামান বছরের পর বছর ধরে একটি মিথ্যাকে ঘিরে জীবন যাপন করছিল এবং সেই চরিত্রটি হিংস্র চতুর্ভুজ হত্যার মধ্য দিয়ে শেষ হয়। পরিবারের প্রিয় সদস্যটির হাতেই তারা প্রাণ হারিয়েছিল, ন্যায়সঙ্গত কারণটি না জেনেই। মূলত নিজেকে গোপন রাখতেই জামান এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল- তবে এখন তা জেনে গেছে পুরো বিশ্ব। সূত্র- মিরর।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *