সু চির বিরুদ্ধে ছয় লাখ ডলার ও সোনা নেয়ার অভিযোগ সেনাবাহিনীর

আন্তর্জাতিক

স্বদেশবাণী ডেস্ক: মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দেশটির ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়া ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি বা এনএলডির নেত্রী অং সান সু চি’র বিরুদ্ধে অবৈধভাবে ছয় লাখ ডলার অর্থ ও সোনা গ্রহণের অভিযোগ এনেছে। গত পহেলা ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের পর এটাকেই তার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর আনা সবচেয়ে শক্তিশালী অভিযোগ বলে মনে করা হচ্ছে। তবে অভিযোগের স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ এখনো প্রকাশ করা হয়নি।

গত পাঁচ সপ্তাহ ধরে অং সান সু চির বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ আনা হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে লাইসেন্সবিহীন রেডিও যন্ত্রসামগ্রী সাথে রাখা, করোনাভাইরাস সংক্রান্ত বিধিনিষেধ ভঙ্গ করা এবং উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়া। কিন্তু এবার তার বিরুদ্ধে নতুন এই গুরুতর অভিযোগ আনলেন সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ঝাউ মিন তুন।

সেনা বাহিনীর অভিযোগে বলা হয়েছে সু চি যে স্বর্ণ গ্রহণ করেছেন তার মূল্য প্রায় সাড়ে চার লাখ পাউন্ড। আজ বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেছেন, ইয়াঙ্গনের সাবেক একজন মুখ্যমন্ত্রী অং সান সু চিকে ছয় লাখ ডলার অর্থ এবং ১১ কেজি স্বর্ণ দিয়েছিলেন। কিন্তু এর বাইরে বিস্তারিত কিছু উল্লেখ করা হয়নি।

ওই মুখপাত্র সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি বা এনএলডির বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলেছেন, যেসব প্রতিবাদকারী নিহত হচ্ছে তাদের মৃত্যুর জন্য তারাই দায়ী। কারণ দলটি তাদেরকে রাস্তায় নেমে আসার জন্য উস্কানি দিচ্ছে।

অং সান সু চির দল গত নভেম্বরের নির্বাচনে বড় জয় পেয়েছিল, যদিও পরে সেনাবাহিনী নির্বাচনে দলটির বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ তোলে। তবে স্বাধীন পর্যবেক্ষকরা সেনাবাহিনীর এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলেছিল যে নির্বাচনে অনিয়ম তারা দেখেননি।

পহেলা ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের পর সু চিকে অজ্ঞাত স্থানে রাখা হয়েছে এবং তার দলের শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাইকেই আটক করে রাখা হয়েছে। সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র বলছেন ইয়াঙ্গনের আঞ্চলিক মন্ত্রী ফিউ মিন থেইন বলেছেন যে তিনি অং সান সু চিকে নিজে নগদ ছয় লক্ষ ডলার অর্থ এবং স্বর্ণ দিয়েছেন। এসব দেওয়া হয়েছে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৮ সালের মার্চ মাসের মধ্যে।

এদিকে দেশটিতে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। পুলিশ ও সৈন্যরা আজও বেশ কয়েকটি শহরে এরকম বিক্ষোভের ওপর গুলি চালালে অন্তত সাতজন নিহত হয়েছে। অনেকের গুলি লাগছে মাথায়। এ যাবত ৬০ জনের বেশি নিহত হবার খবর পাওয়া গেছে।

ফলে মনে করা হচ্ছে যে আন্তর্জাতিক সমালোচনা উপেক্ষা করে হত্যার উদ্দেশ্যেই গুলি চালানো হচ্ছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের দেওয়া এক বিবৃতিতে বিক্ষোভকারীদের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নিন্দা জানিয়ে এর সমালোচনা করা হয়েছে। তবে এসব সমালোচনা প্রত্যাখ্যান করে উল্টো সহিংসতার জন্য অং সান সু চিকেই তারা দায়ী করছে।

মিয়ানমারের স্বাধীনতার নায়ক জেনারেল অং সানের মেয়ে অং সান সু চি। তার যখন দুই বছর বয়স তখন তার বাবাকে হত্যা করা হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র দুই বছর পর এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল।

সু চিকে একসময় মানবাধিকারের বাতিঘর বলা হত- যিনি একজন নীতিবান অধিকারকর্মী হিসেবে দশকের পর দশক ধরে মিয়ানমারের শাসন ক্ষমতায় থাকা নির্দয় সামরিক জেনারেলদের চ্যালেঞ্জ করতে নিজের স্বাধীনতাকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন। তাকে ১৯৯১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয় এবং তাকে “ক্ষমতাহীনদের ক্ষমতার অনন্য উদাহরণ” হিসেবে সম্বোধন করা হত। তখনও তিনি গৃহবন্দীই ছিলেন।

সু চি ১৯৮৯ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে অন্তত ১৫ বছর বন্দী জীবন কাটিয়েছেন। তিনি ২০১৫ সালের নভেম্বরে ২৫ বছরের মধ্যে প্রথমবার অনুষ্ঠিত অবাধ নির্বাচনে অংশ নিয়ে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি এনএলডি’র নেতৃত্ব দেন। যাতে বড় ধরণের জয় পান তিনি।

মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি কারণ তার সন্তানেরা বাইরের দেশের নাগরিক। তবে ৭৫ বছর বয়সী সু চি একজন ডি ফ্যাক্টো নেতা হিসেবেই সুপরিচিত। তবে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর তার নেতৃত্বকে দেশটিতে মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি আচরণ দিয়েই বর্ণনা করা হয়।

রাখাইন রাজ্যে ২০১৭ সালে পুলিশ স্টেশনে এক প্রাণঘাতী হামলার পর রোহিঙ্গাদের উপর সেনাবাহিনীর নির্যাতন শুরু হলে লাখ লাখ রোহিঙ্গা, প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়।

তবে সু চির সাবেক আন্তর্জাতিক সমর্থকরা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন যে, তিনি ধর্ষণ, হত্যা এবং সম্ভাব্য গণহত্যা রুখতে কোন পদক্ষেপ নেননি এবং ক্ষমতাধর সামরিক বাহিনীর নিন্দা কিংবা তাদের নৃশংসতার মাত্রাও স্বীকার করেননি।

প্রাথমিকভাবে অনেকেই তার পক্ষে যুক্তি দেয়ার চেষ্টা করে বলেছেন যে, তিনি একজন বাস্তববাদী রাজনীতিবিদ যিনি বহু-জাতি বিশ্বাসের সম্প্রদায়ভুক্ত একটি দেশ শাসন করছেন যার জটিল ইতিহাস রয়েছে।

তবে ২০১৯ সালে দ্য হেগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে অনুষ্ঠিত শুনানিতে সামরিক বাহিনীর পদক্ষেপের বিষয়ে তার নিজের স্বপক্ষে উপস্থাপিত যুক্তি এর মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এর পর তার আন্তর্জাতিক সুনাম বলতে তেমন কিছু অবশিষ্ট থাকে না। দেশের ভেতরে “দ্য লেডি” নামে পরিচিত মিজ সু চি বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠদের কাছে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়, যারা রোহিঙ্গাদের প্রতি তেমন সহানুভূতিশীল নয়। সূত্র: বিবিসি বাংলা

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *