গ্রহাণুর সঙ্গে পৃথিবীর সংঘর্ষের সম্ভাবনা কতখানি

আন্তর্জাতিক

স্বদেশবাণী ডেস্ক: পৃথিবীর সংগে সংঘর্ষ হতে পারে এমন গ্রহাণুকে তার গতিপথ থেকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেবার এক প্রযুক্তি পরীক্ষা করে দেখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসা ডার্ট নামের একটি যান পাঠিয়েছে।

এই মহাকাশযানটি ডাইমরফোস নামের একটি গ্রহাণুর ওপর আঘাত হানবে এবং তারপর পরীক্ষা করে দেখা হবে – এর কক্ষপথ এবং গতিবেগে কোন পরিবর্তন হলো কি না। এটি এধরনের প্রথম পরীক্ষা।

নাসার বিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ ওই গ্রহাণু যখন পৃথিবীর ৬৭ লক্ষ মাইলের মধ্যে আসবে – তখনই ডার্টের সাথে সংঘর্ষ ঘটবে। ঘন্টায় প্রায় ১৫,০০০ মাইল বেগে ডাইমরফোসের গায়ে আঘাত হানবে ডার্ট।

 

পৃথিবীর সঙ্গে সংঘর্ষের পরিণতি
ধরা যাক, কোনো একটি গ্রহাণু পৃথিবীকে আঘাত করলো, এবং সেটি গিয়ে পড়ল কোনো একটি দেশের কোনো একটি শহরে। তাহলে কি শুধু ওই শহরটিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে?

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি নির্ভর করবে গ্রহাণুটি আকারে কত বড়ো তার উপর।

যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার বিজ্ঞানী ড. অমিতাভ ঘোষ বলছেন, “সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে গ্রহাণুর সাথে যে সংঘর্ষের কারণে ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, বিজ্ঞানীরা মনে করেন গ্রহাণুটি এত জোরে পড়েছিল যে এর ফলে বায়ুমণ্ডলে অনেক ধুলো ছড়িয়ে পড়ে। একারণে কয়েক বছর কিম্বা কয়েক মাসের জন্য সূর্যের আলো পৃথিবীতে পৌঁছাতে পারেনি।”

কিন্তু প্রাণের বেঁচে থাকার জন্য সূর্যের আলো খুবই জরুরি।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, গ্রহাণুর সঙ্গে পৃথিবীর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলে সেটি হবে পারমাণবিক বোমার চেয়েও শক্তিশালী।

ড. ঘোষ বলেন, কোনো একটি শহরে গ্রহাণু এসে পড়লে ধ্বংসযজ্ঞ শুধু ওই শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, পুরো গ্রহেই তার প্রভাব পড়বে। যদি একটা জায়গায় প্রভাব পড়তো তাহলে তো শুধু সেখানকার ডাইনোসরগুলো মারা যেত। বিলুপ্ত হতো না। কারণ অন্য জায়গার ডাইনোসর বেঁচে থাকতো।

“সংঘর্ষের ফলে যদি কোথাও বড় ধরনের আগুন লেগে যায়, কিম্বা একটা বিশাল গর্ত তৈরি হয় এবং সেখান থেকে যদি সব ধ্বংসাবশেষ বায়ুমণ্ডলে চলে যায়, তাহলে সারা গ্রহেই ধুলোবালি ছড়িয়ে পড়তে পারে। এরকম হলে পৃথিবীর প্রাণীরা হয়তো বেঁচে থাকতে পারবে না।”

এরকম ধূলিঝড় বা ডাস্ট স্টর্ম মঙ্গল গ্রহে দেখতে পাওয়া যায়। এর ফলে সেখানে সূর্যের আলো দেখা যায় না। নাসার পাঠানো রোভার এই ধূলিঝড় প্রত্যক্ষ করেছে।

সংঘর্ষের সম্ভাবনা কতখানি
ধারণা করা হয় যে পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদের সৃষ্টি হয়েছিল মঙ্গলের মতো একটি বস্তুর সাথে পৃথিবীর সংঘর্ষের ফলেই। পৃথিবী ভেঙে তার টুকরো দিয়েই চাঁদের জন্ম হয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর সঙ্গে এসব গ্রহাণুর সংঘর্ষের সম্ভাবনা কতোখানি – সেটা বলা খুব কঠিন। তবে এধরনের ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটছে।

গত শতাব্দীর শুরুর দিকে রাশিয়াতে একটি গ্রহাণু পড়েছিল যা পারমাণবিক বিস্ফোরণের মতো আঘাত হেনেছিল, যার ফলে একটি বন ধ্বংস হয়ে যায়।

আর এটা তো সবারই জানা যে সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে বড় আকারের একটি গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত হেনেছিল। এর ফলে সারা পৃথিবী থেকে ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে যায়। এই প্রাণীটি কোটি কোটি বছর ধরে পৃথিবীতে মহা-দাপটের সঙ্গে বিচরণ করতো।

নাসার বিজ্ঞানী ড. অমিতাভ ঘোষ বলছেন, পৃথিবীর সঙ্গে গ্রহাণুর আবার এধরনের সংঘর্ষের সম্ভাবনা কতো তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন।

“কিন্তু এরকম জিনিস ঘটে এবং ঘটছে। আগামী ১০ বছরে, কী ১০০ বছরে, কী ১০০০ বছরে এরকম আরো একটি ঘটনা ঘটবে কি না, ঘটলে কখন ঘটবে-সেসব বলা খুবই শক্ত,” বলেন তিনি।

গ্রহাণুর সংখ্যা কতো
সৌরজগতের সৃষ্টির সময়েই এসব গ্রহাণু তৈরি হয়েছে। পৃথিবীর আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে এরকম গ্রহাণুর সংখ্যা কতো সেটা সুনির্দিষ্ট করে জানা সম্ভব নয়। তবে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন পৃথিবীর নিকটবর্তী গ্রহাণুর সংখ্যা ১০ হাজার থেকে ১০ লাখ পর্যন্ত হতে পারে।

এসব গ্রহাণুর বেশিরভাগই আকারে ছোট।

ড. ঘোষ বলেন, মঙ্গল আর বৃহস্পতি গ্রহের মধ্যে কয়েক কোটি গ্রহাণু ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে ধারণা করা হয়।

তিনি বলেন, “কোনো গ্রহের সঙ্গে কোনো একটি গ্রহাণুর সংঘর্ষ অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। ৪৫০ কোটি বছর আগে যখন পৃথিবী, মঙ্গল এসব গ্রহের সৃষ্টি হয় তখন গ্রহাণুর সঙ্গে সংঘর্ষের ফলেই গ্রহগুলো আকারে বড় হয়েছে। আজকে যে পৃথিবী এত বড় হয়েছে এর কারণ বিভিন্ন গ্রহাণুর সঙ্গে সংঘর্ষ।”

“আমাদের সৌরজগতে এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া,” বলেন তিনি।

বিভিন্ন দেশের ও সংস্থার টেলিস্কোপের মাধ্যমে এসব গ্রহাণুর ওপর নজর রাখা যায়।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এগুলো কোন দিকে যাচ্ছে, কোথা থেকে যাচ্ছে, কতো জোরে ছুটছে, দশ দিন পর কোন দিকে যাবে, ছ’মাস পরে কোথায় যাবে – এর সবই ট্র্যাক করা সম্ভব।

“কিন্তু এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আপনি ক’টা গ্রহাণু ট্র্যাক করবেন? ১০ হাজার ট্র্যাক করবেন না কি ১০ লাখ করবেন? এসব নিয়ে কতজন কাজ করবে এবং এতো টাকাই বা কোত্থেকে আসবে,” – বলেন ড. ঘোষ।

গতিপথ বদলাতে পারবে?
নাসা যে গ্রহাণুটিকে লক্ষ্য করে যান পাঠিয়েছে তার নাম ডাইমরফোস। এটি আকারে একটি ১৬০ মিটার চওড়া। কিন্তু যে মহাকাশ যান দিয়ে এটিকে ধাক্কা দেওয়া হবে সেটি আকারে এই গ্রহাণুর তুলনায় খুবই ছোট।

ডার্টের আকার।
এরকম একটি ছোট্ট যান কিভাবে এতো বড় গ্রহাণুর গতিপথ পরিবর্তন করবে?

অমিতাভ ঘোষ বলছেন, “ভেবে দেখুন খুব বড় একটি ট্রেন আসছে। একটি গাড়ি দিয়ে খুব জোরে ট্রেনটিকে ধাক্কা দেওয়া হলো। ট্রেনটির তখন লাইন থেকে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।”

নাসার বিজ্ঞানীরাও এরকম একটি ধারণা পরীক্ষা করে দেখতে চাইছেন যে ছোট একটি যান দিয়ে খুব জোরে ধাক্কা দিলে গ্রহাণুর গতিপথ কতোটা বদলে যেতে পারে?

“এখানে তিনটি জিনিস বিবেচনা করতে হবে- হয় অনেক জোরে আঘাত হানতে হবে, অন্যথায় যেটি দিয়ে আঘাত করা হবে সেটি অনেক বড় হতে হবে, অথবা দুটোই। এভাবে কি গ্রহাণুর গতিপথ পরিবর্তন করা সম্ভব? এর উত্তর দেওয়া খুব কঠিন,” বলেন ড. ঘোষ।

যদি গ্রহাণুটি আকারে খুব বড় হয় তাহলে তাকে ধাক্কা দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ একটি স্যাটেলাইট ১০ মাইল চওড়া গ্রহাণুর তুলনায় কিছুই নয়।

নাসা বলছে, ডাইমরফোস গ্রহাণুটির আরেকটি বড় গ্রহাণুকে কেন্দ্র করে একবার ঘুরে আসতে সময় লাগে ১১ ঘণ্টার মতো। তারা আশা করছেন সেখানে ৬০/৭৫ সেকেণ্ডের মত পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হতে পারে।

সামান্য এই পরিবর্তন ঘটলেই গ্রহাণুর গন্তব্য অনেকখানিই বদলে যাবে।

নাসার বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাদের উদ্দেশ্য গ্রহাণুকে ধ্বংস করা নয়, বরং তার গতিপথ পরিবর্তন করা। এবং এতে তারা সফল হবেন বলেই আশা করছেন।

অমিতাভ ঘোষ বলেন, “ধরা যাক এক মাসের মধ্যে কোনো একটি গ্রহাণুর সঙ্গে একটা সংঘর্ষ ঘটবে। ওই গ্রহাণুকে থামানোর জন্য কোনো দেশেরই পরিকল্পনা বা প্রস্তুতি কিছুই নেই।”

নাসা এখন দেখার চেষ্টা করছে সেরকম কোনো পরিকল্পনা তৈরি করা সম্ভব কি না! সূত্র: বিবিসি

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *