আন্তর্জাতিক ডেস্ক: দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্বের কথা কে না জানে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই এক পক্ষ ডানে গেলে আরেক পক্ষ যায় বামে। বহু ইস্যুতে দুই পক্ষকে পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিতে দেখা গেছে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ ইস্যুতে অনেকটা একই পথের পথিক ভারত ও পাকিস্তান। উভয় দেশই সরাসরি রুশ আগ্রাসনের প্রতিবাদ না জানিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে শুধু শান্তি বজায় রাখার কথা বলেই ক্ষান্ত।
গত রোববার (২৭ ফেব্রুয়ারি) ইউক্রেনীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি। এসময় পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। ইউক্রেন সংকট নিয়ে পাকিস্তান সরকারের বিবৃতির সঙ্গে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের বক্তব্য ও ইউক্রেনীয় নেতাদের সঙ্গে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কথোপকথনের অনেকটাই মিল দেখতে পাওয়া যায়।
বিজ্ঞাপন
গত শনিবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে মোদীর। এসময় এ সংকটের পেছনে কে দায়ী তা উল্লেখ না করেই সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। ওই ফোনালাপের বিষয়ে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নরেন্দ্র মোদী অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধ ও সংলাপে ফিরতে ফের আহ্বান জানিয়েছেন এবং শান্তিপ্রতিষ্ঠায় যেকোনো উপায়ে অবদান রাখতে ভারতের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন।
এর দু’দিন আগে রাশিয়া যেদিন ইউক্রেন আক্রমণ করলো, সেদিন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে ফোন করেছিলেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। সেখানেও তার বক্তব্যের ভাষা ছিল প্রায় একই। ভারত সরকারের বিবৃতিতে জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রী মোদী তার দীর্ঘদিনের বিশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করেছেন যে, রাশিয়া ও ন্যাটো জোটের মতপার্থক্য শুধু সৎ ও আন্তরিক আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান হতে পারে। তিনি অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধ এবং কূটনৈতিক আলোচনা ও সংলাপের পথে ফিরতে সব পক্ষ থেকে সমন্বিত প্রচেষ্টার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
এর মধ্যে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত একটি নিন্দা প্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকেও বিরত ছিল ভারত।
এদিকে, গত বৃহস্পতিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান মস্কো সফরে গিয়ে সরাসরি পুতিনের সঙ্গে বিশাল গ্যাস পাইপলাইনের চুক্তি ও আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ইস্যু নিয়ে কথা বলেছেন। তাদের বৈঠক সম্পর্কে রাশিয়ার বিবৃতিতে ইউক্রেন নিয়ে কোনো কথা ছিল না। তবে ইমরান খানের কার্যালয় থেকে দেওয়া বিবৃতিতে খুবই সতর্কভাবে শুধু বলা হয়, পাকিস্তান বর্তমান পরিস্থিতির জন্য ‘দুঃখিত’।
পাকিস্তানের বক্তব্য ছিল, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জোর দিয়ে বলেছেন, সংঘাত কারও জন্য উপকারী নয়। এতে সবসময় উন্নয়নশীল দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাকিস্তান বিশ্বাস করে, সব বিরোধ আলোচনা ও কূটনীতির মাধ্যমে সমাধান হওয়া উচিত।
কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের এই একই পথে চলার কারণ কী? চলুন জেনে নেওয়া যাক-
ভারত-রাশিয়ার পুরোনো বন্ধন
ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে সুসম্পর্ক কয়েক দশকের পুরোনো। বিশ্লেষকদের মতে, দক্ষিণ এশীয় দেশটিতে রুশ অস্ত্র রপ্তানিসহ অন্যান্য খাতে ব্যাপক সহযোগিতাই এর বড় কারণ। গত কয়েক বছরে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়েছে, যার প্রমাণ, মার্কিনিদের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের সামরিক জোট কোয়াডের অন্যতম সদস্য নয়াদিল্লি।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) তথ্যমতে, ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে রাশিয়ার মোট অস্ত্র রপ্তানির আনুমানিক ২৩ শতাংশ গিয়েছিল ভারতে। একই সময়ে ভারতের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ছিল মোট অস্ত্র আমদানির অন্তত ৪৯ শতাংশ।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে পুতিনের নয়াদিল্লি সফরের পরপরই ভারত সরকার জানায়, তারা রাশিয়ার অত্যাধুনিক এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পেতে শুরু করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে নিন্দা প্রস্তাবে ভারতের ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকার কারণ সম্ভবত রুশ অস্ত্র আমদানি এবং যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন সম্পর্কিত দ্বন্দ্ব ইস্যুতে নয়াদিল্লির প্রায় একই ধরনের অবস্থান।
রাশিয়ার কাছে ঘেঁষার চেষ্টায় পাকিস্তান
স্নায়ুযুদ্ধের সময় পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করায় রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কে বেশ অবনতি হয়। তবে গত কয়েক বছরে তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অনেকটাই উন্নতি হয়েছে।
তবে ইউক্রেন আক্রমণের দিনই রাশিয়া সফরে যাওয়ায় পাকিস্তানেই বিতর্কের মুখে পড়েছেন ইমরান খান। সেদিন পুতিনের সঙ্গে প্রায় তিন ঘণ্টা পাশাপাশি বসে কথা বলেছেন তিনি। প্রায় দুই দশকের মধ্যে প্রথম পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গত সপ্তাহে মস্কো সফরে গিয়েছিলেন ইমরান খান।
ইমরানের সফরে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল পাকিস্তান স্ট্রিম গ্যাস পাইপলাইন। প্রায় ১১শ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রস্তাবিত এই পাইপলাইন দিয়ে বন্দরনগরী করাচি থেকে পাঞ্জাব প্রদেশ পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ হওয়ার কথা রয়েছে। ২০১৫ সালে প্রকল্পটি চূড়ান্ত হলেও নানা কারণে বারবার পিছিয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে ২০২১ সালে নতুন চুক্তিতে ফের আশার আলো দেখতে শুরু করেছেন পাকিস্তানিরা। ২৫০ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিতব্য এই পাইপলাইন দিয়ে বছরে ১ হাজার ২৪০ ঘনমিটার গ্যাস সরবরাহ সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পাইপলাইনের কারণে রাশিয়ার গ্যাস রপ্তানি না বাড়লেও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু গ্যাস রপ্তানি পাকিস্তানে সরে যেতে পারে, যা ইউরোপকে রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল করে তুলবে।
সূত্র: আল জাজিরা
স্ব:বা/না