ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পরও অধ্যাদেশ ভঙ্গ করে পরীক্ষায় অংশ নিতে যাচ্ছেন রাবির সাবেক ছাত্রলীগ নেতা!

লীড শিক্ষা

রাবি প্রতিনিধি: রাবি ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান রানার সঙ্গে মোস্তাকিম বিল্লাহ (মাঝে)ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পরও অধ্যাদেশ বহির্ভূতভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতাকে মাস্টার্সের পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিশেষ বিবেচনায় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তাকে পরীক্ষার সুযোগ করে দিয়েছে বলে জানা গেছে।

অভিযুক্ত সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাকিম বিল্লাহ্ ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হন। তিনি ছাত্রলীগের মিজানুর রহমান রানা ও খালিদ হাসান বিপ্লবের কমিটির পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী, একজন শিক্ষার্থীকে ভর্তি হওয়ার তিন একাডেমিক বছরের মধ্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করতে হয়। সে হিসেবে মোস্তাকিম বিল্লাহর ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে। কিন্তু সম্প্রতি তিনি বিভাগে ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে মাস্টার্স পরীক্ষার ফরম পূরণ করেছেন। আগামী ৩০ অক্টোবর থেকে এ পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।

বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মোস্তাকিম ২০১৫-১৬ বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নেননি। ২০১৭ সালের স্নাতকোত্তর পরীক্ষা শুরু হয় ২০১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। সেবার পরীক্ষায় অংশ নেন মোস্তাকিমসহ ৭৬ শিক্ষার্থী। ২৬ ফেব্রুয়ারি ৫০৪ কোর্স পরীক্ষায় ওই হলের ডিউটিরত শিক্ষক সুলতান মাহমুদ রানার সঙ্গে ‘বাজে’ আচরণ করেন মোস্তাকিম। পরে ওইদিনই বিভাগ থেকে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বরাবর অভিযোগ দেওয়া হয়। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ দফতর হয়ে অভিযোগটি ডিসিপ্লিনারি কমিটিতে যায়। তাদের সুপারিশক্রমে ৪৮১তম সিন্ডিকেট সভায় মোস্তাকিমকে দুই বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। ফলে তিনি ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি।

চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল মোস্তাকিম বিভাগের সভাপতিকে মাধ্যম করে উপাচার্য বরাবর শাস্তি মওকুফের একটি আবেদন করেন। বিভাগ কোনও প্রকার সুপারিশ না করে আবেদনের ওপর শুধু ‘প্রেরিত হলো’ লিখে উপাচার্যের কাছে পাঠায়। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান বিষয়টি ৪৯০তম সিন্ডিকেট সভায় তোলেন। পরে মোস্তাকিমের শাস্তি মওকুফ করে ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি দেয় সিন্ডিকেট।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক এক্রাম উল্লাহ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নিজস্ব অধ্যাদেশ রয়েছে। সে অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয়। সেখানে উল্লেখ আছে একজন শিক্ষার্থীকে সর্বোচ্চ তিন বছরের মধ্যে তার মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করতে হবে। সে হিসেবে মোস্তাকিম বিল্লাহ্র ছাত্রত্ব শেষ হয়ে গেছে।’

তাহলে তার ব্যাপারে সুপারিশ করা হয়েছে কেন? এমন প্রশ্নে এক্রাম উল্লাহ বলেন, ‘বিভাগের পক্ষ থেকে কোনও ধরনের সুপারিশ করা হয়নি। মোস্তাকিম একটি আবেদন করেছিল। বিষয়টি আমরা আমাদের একাডেমিক সভায় আলোচনা করি। সেখানে নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কোনও প্রকার সুপারিশ না করে “প্রেরিত হল” মর্মে লিখিত দিয়ে আমরা প্রশাসনের কাছে পাঠাই।’ বিভাগের সভাপতি এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, মোস্তাকিম বিল্লাহ তার রাজনৈতিক আধিপত্য দেখিয়ে বিভাগের অনেক শিক্ষকের সঙ্গে বিভিন্ন সময় অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন। এছাড়া ২০১৪ সালে ১৩ মে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের মাস্টার্সের পরীক্ষা কক্ষে শিক্ষকদের পিস্তল দেখিয়ে পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। ওইদিনই তাকে ছাত্রলীগ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ২০১৫ সালের ৩ আগস্ট শাখা ছাত্রলীগের সম্মেলনকে সামনে রেখে তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। এছাড়াও ২০১৪ সালে ২ ফেব্রুয়ারি সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ছাত্রলীগের হামলার সময় তাকে অস্ত্র নিয়ে ঘুরতে দেখার অভিযোগ রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সিনিয়র শিক্ষক ও সাবেক সিন্ডিকেট সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিন্ডিকেট চাইলে বিশেষ বিবেচনায় শাস্তি মওকুফ করতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে যুক্তিযুক্ত কোনও বিষয় থাকতে হয়, যা বিবেচনা করে শাস্তি মওকুফ করা হয়।

এক্ষেত্রে কী বিবেচনায় সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতার শাস্তি সিন্ডিকেট মওকুফ করেছে তা জানতে চাইলে এ নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা। আরেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়ার মন্তব্য জানতে একাধিকবার দফতরে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সিন্ডিকেট সদস্য বলেন, ‘সিন্ডিকেটে এই শিক্ষার্থীর একাডেমিক সেশন কৌশলে উল্লেখ করা হয়নি। সে শাস্তি মওকুফ চেয়ে আবেদন করেছে সেক্ষেত্রে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তাকে পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে সিন্ডিকেট। কিন্তু একাডেমিকভাবে তিন বছর শেষ হয়েছে। সেক্ষেত্রে তিনি পরীক্ষা দিতে পারেন না। বিগত সময় অনেক শিক্ষার্থীর বেলায় এমনই ঘটেছে।’

জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রয়ক মো. বাবুল ইসলাম বলেন, ‘কিসের বিবেচনায় তার শাস্তির মওকুফ করে পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে সেটি আমার জানা নেই। আমি সিন্ডিকেট সদস্য নই। তাই সিন্ডিকেটে অ্যাক্সেসের সুযোগ নেই।’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনু বলেন, ‘মোস্তাকিম বিল্লাহ্ ছাত্রলীগের কেউ না। তাকে কী বিবেচনায় পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে আমি অবগত নই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই ভালো বলতে পারবে।’

জানতে চাইলে মোস্তাকিম বিল্লাহ বলেন, ‘আমি ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের সবগুলো পরীক্ষা দিয়েছিলাম। ভাইভা দেওয়ার পর আমাকে চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়, আমাকে ওই বছরসহ আগামী দুই বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। পরে আমি শাস্তি মওকুফের আবেদন করেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মানবিক দিক বিবেচনা করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে আমার শাস্তি মওকুফ করেছে।’

বিশেষ বিবেচনায় সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতার শাস্তি মওকুফ করে পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতির বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক এমএ বারী স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। ২৪ অক্টোবর তার দফতরের গেলে দফতরের উপ- রেজিস্ট্রার মো. মখলেছুর রহমান বলেন, ‘রেজিস্ট্রার স্যার ঢাকায় আছেন। পরে মুঠোফোনে অধ্যাপক এমএ বারী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি এখন ঢাকায় আছি। বিষয়টি এ মুহূর্তে কিছু বলতে পারছি না। দেখে বলতে হবে।’ পরে ২৭ অক্টোবর সকালে তার দফতরে গেলে তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন দেখে বলতে পারবেন এবং দুপুরের পরে আসার জন্য বলেন। বিকাল ৩টার দিকে গেলে দফতরের এক কর্মকর্তা জানান, রেজিস্ট্রার স্যার দফতরে নেই। পরে সোয়া ৩টার দিকে আবারও গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে অধ্যাপক বারী বলেন, ‘ক্যালেন্ডার দিয়ে যেতে বলেছিলাম কিন্তু এখনও পাইনি। আসলে দেখে বলতে পারবো।’

এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহানের মন্তব্য জানতে ২৪ অক্টোবর তার দফতরে গেলে সহকারী রেজিস্ট্রার নারায়ণ চন্দ্র বর্মণ জানান উপাচার্য ঢাকায় আছেন। পরে ২৭ অক্টোবর বিকালে তার দফতরে গিয়ে এক ঘণ্টারও বেশি সময় অপেক্ষা করেও সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি। পরে মুঠোফোনে কল দিলেও ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন।

স্ব.বা/শা

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *