প্রতারকের প্রতারণা, নিঃস্ব যুবকের পরিবার

রাজশাহী লীড

বাগাতিপাড়া (নাটোর) প্রতিনিধিঃ জন্মের পর আদরের সন্তানের নাম পাইলট রেখেছিলেন মা-বাবা। আশা ছিলো পাইলট হয়েই আকাশ ছোঁবে সে। অভাবের সংসারে জন্ম নিয়ে তা আর হয়ে উঠেনি। তবে বিমানে চেপে সৌদি আরবে গিয়ে চাকুরীর একটি সুযোগ এলে সন্তানের ভবিষ্যত মঙ্গলের কথা ভেবে শেষ সম্বল ১০কাঠা জমি ৪ লাখ টাকায় বিক্রি করেন বাবা মোজাহার আলী।

সাড়ে সাত লাখ টাকা যোগাতে দাদী দিয়ে দেন দাদুর শেষ সম্বল তিন শতাংশ জমি। বিক্রি করে তুলে দেন এক লাখ টাকা, ছোট চাচা ময়েন উদ্দীন নিজের ভাগের জমি বিক্রি করে দেন এক লাখ টাকা। মা বিজলী বেগমও গহনা বিক্রি করে দেন আরো এক লাখ টাকা। বাকী ৫০ হাজার টাকার ব্যবস্থা করেন প্রতিবেশী সাইফুল ইসলাম।

ছয় মাস আগে এভাবেই একে একে শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে সৌদি আরব যাবার প্রস্ততি নিচ্ছিলেন নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার পাকা ইউনিয়নের তকিনগর গ্রামের মোজাহার আলীর ছেলে পাইলট আলী(২৪)। তবে প্রতারকের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খুঁইয়ে এখন নিঃস্ব তার পরিবার। একই গ্রামের বিচ্ছেদ আলী পাইলটকে সৌদি আরবে একটি হোটেল বয় হিসেবে চাকুরীর জন্য পাঠানোর প্রস্তাব দেন তার বাবা মোজাহার আলীকে। মোজাহার আলী রাজী হলে প্রথমে চার লাখ টাকা নেন বিচ্ছেদ আলী। এরপর নানা অজুহাতে নেন আরও সাড়ে ৩লাখ টাকা।

মোজাহার আলী বলেন, সৌদি আরব যাবার আগে ছেলে পাইলটকে জামাকাপড়, একটি লাগেজ ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে দেন তিনি। ৬ লাখ টাকা জমা দেয়ার পর ভিসার কপি হাতে পেলে দেখা গেল সেটি জাল। ভিসার নম্বরের সাথে উল্লিখিত ব্যক্তির নাম মেলে না। বিষয়টি বিচ্ছেদ আলীর নজরে আনলে তিনি প্রথমে ভুল স্বীকার করেন এবং নতুন করে ভিসার ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেন। ভিসা এবং মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য চান আরও দেড় লাখ টাকা। দেড় লাখ টাকা না হলে সব প্রচেষ্টা শেষ হয়ে যাবে বলে জানানোর পর আবারও টাকা দেয়া হয়। এরপর ভিসা দিতে দেরী হলে বিচ্ছেদ আলীর উপর সন্দেহ হয়। দীর্ঘদিন বাহরাইন প্রবাসী একই গ্রামের সাইফুল ইসলামকে পুরো ঘটনা জানালে তিনি কাগজপত্র দেখে জানান তারা প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন।

এরপর বিচ্ছেদ আলী আরেকটি ভিসা এনে দেন। দেখা যায় দ্বিতীয় ভিসাটিও ভুয়া। ভিসাটির প্রকৃত ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ আল ইউসুফ। এ নিয়ে এলাকায় একটি সালিশ অনুষ্ঠিত হয়। চাপের মুখে সালিশে মাত্র আড়াই লাখ টাকা দিতে সম্মত হয় বিচ্ছেদ আলী। না মেনে আইনের আশ্রয় নিতে গেলে এখন প্রাণণাশের হুমকি দেয়া হচ্ছে। অভিযুক্তরা প্রকাশ্যে এলাকায় ঘুরছে।

এ ঘটনায় গত ৩০শে অক্টোবর অভিযুক্ত বিচ্ছেদ আলী(৫৫) ও তার তিন ছেলে হাসান আলী(২২), রাকিবুল ইসলাম(২৬) ও বিপ্লব হোসেনকে আসামী করে(২২) বাগাতিপাড়া থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন পাইলটের বাবা মোজাহার আলী।

শনিবার(২রা নভেম্বর)তকিনগরে বিচ্ছেদ আলীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পাইলটের বিদেশে যাবার খরচ যোগাতে বিক্রির জন্য কেটে রাখা একটি মেহগনি গাছ এখনও উঠানে পড়ে আছে। উঠান পেরিয়ে একটি খড়ের ছোট্ট ঘরে পাইলট, তার চাচা মিজানুর রহমান ও দাদী শাহিদা বেওয়া থাকেন। অপর একটি ঘরে থাকে পাইলটের মা-বা। ছেলেকে বিদেশে পাঠাতে নিঃস্ব হয়ে বাবা মোজাহার আলী এখন দিনমজুরী করছেন। মা বিজলী বেগম নির্বাক।

পাইলট আলী বলেন, ‘আমার মেডিক্যাল পরীক্ষার নামে ঢাকায় নিয়ে একটি হাসপাতালে সারাদিন বসিয়ে রাখেন বিচ্ছেদ আলী ও লোকজন। রাত হলে জানান, তারা সব কিছু ম্যানেজ করে নিয়েছেন, পরীক্ষা না করলেও চলবে। সৌদি যাওয়া ফাইনাল।’

প্রতিবেশী সাইফুল ইসলাম বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে যেতে হলে বেশ কিছু শর্ত পূরণ করতে হয় দুতাবাসের চাহিদা অনুসারে। সে অনুযায়ী নির্ধারিত তিনটি হাসপাতালে পরীক্ষা না করাতেই প্রতারণার বিষয়টি আঁচ করি। পরে ভিসাতেও জালিয়াতি ধরা পড়ে।

পাইলটের দাদু (বাবার চাচা)বলেন, ‘অনেক অনটনেও আমরা নিজেদের জমি বিক্রি করিনি। কিন্ত নাতিটার কথা ভেবে আর কার্পণ্য করিনি। অথচ আমাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে।

অশ্রুসজল চোখে পাইলটের দাদী শাহিদা বেওয়া বলেন, তার স্বামী মারা যাবার আগে তিন শতাংশ জমি তার নামে দিয়ে যান। নাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে সে জমিটিও নামমাত্র দামে বিক্রি করে দেন। নাতি বিদেশে তো যেতে পারলই না বরং তারাই আজ নিঃস্ব।

এ বিষয়ে বক্তব্য নিতে অভিযুক্ত বিচ্ছেদ আলীর বাড়িতে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে তার বোন আসমা বেগম অভিযোগ অস্বীকার করে সাফ জানিয়ে দেন তার ভাইয়ের সাথে পাইলটের পরিবারের কোন রকম লেনদেন হয়নি।

স্থানীয় সাবেক ইউপি সদস্য আকরাম হোসেন জানান, তিনি দ্র“ত পাইলটের পরিবারকে অর্থ ফেরত দিতে অনুরোধ করেছেন বিচ্ছেদ আলীকে। তবে বিচ্ছেদ এ নিয়ে কোন কর্ণপাত করেনি।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও বাগাতিপাড়া থানার উপ-পরিদর্শকক(এসআই) সাজ্জাদুর রহমান জানান, অভিযোগটি পাওয়ার পর দুপক্ষের সাথে কথা বলে জানা গেছে তাদের মধ্যে আর্থিক লেনদেন হয়েছে। এ ব্যাপারে আগামী মঙ্গলবার উভয় পক্ষকে থানায় ডাকা হয়েছে। অবস্থা অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

স্ব.বা/শা

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *