আমরা ভালো থাকতে চাই : তুষার আবদুল্লাহ

গণমাধ্যম

স্বদেশ বাণী ডেস্ক: তুষার আবদুল্লাহ অন্যের হেঁসেলে কী রান্না হচ্ছে—সেই খবর নিতে গিয়ে দেখি নিজ ঘরের হাঁড়িতেই ভাত বাড়ন্ত। গণমাধ্যমের কলম, মাইক্রোফোন হন্যে হয়ে ছুটছে। পোশাক কারখানা শ্রমিকরা বেতনের দাবিতে রাস্তায়। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে পোশাক তৈরির কারখানা। পাটকল শ্রমিকরা বেতনের দাবিতে অনশনে। শিক্ষকরাও এমপিওভুক্তি বা বেতন বাড়ানোর দাবিতে সড়কে। বহুজাতিক কোম্পানি, শিল্পগোষ্ঠীতে বিনা নোটিশে ছাঁটাই।

এসব শিরোনামের আড়ালে নিজেদের দীর্ঘশ্বাস,আতঙ্ক রয়ে যায় আড়ালে। এই মুহূর্তে হেমন্ত বিষণ্ন। প্রকৃতিতে নিম্নচাপ। এই আবহাওয়া গণমাধ্যমে বিরাজমান দীর্ঘদিন। নিম্নচাপ কেটে যাওয়ার কোনও নিকট-সম্ভাবনা নেই। বরং গণমাধ্যমকর্মীদের পেশা ও ব্যক্তিগত জীবনে বড় ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। নিম্নচাপের প্রভাবে এরই মধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন বেশ কয়েকজন সহকর্মী।

এই সংকট একসময় ছিল সংবাদপত্রে। স্বৈরাচার এরশাদ পতনের পর দেশে সংবাদপত্রের বিস্ফোরণ ঘটে। রাজধানীসহ সারাদেশে সহস্রাধিক সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক ও দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে। শিল্পগোষ্ঠী, রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি সাধারণ ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীরা পত্রিকার প্রকাশক হিসেবে আবির্ভূত হন। জনবলের প্রায় শতভাগ ছিল তারুণ্য। এই সময়ে তরুণরা সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন রঙিন স্বপ্ন নিয়ে। সত্য বলা, নির্ভীকভাবে কথা বলার স্বাধীন পেশা হিসেবে তারা সাংবাদিকতাকে বেছে নিয়েছিলেন। তারুণ্যের সেই স্বপ্নে কোনও খাদ ছিল না। খাদ ছিল উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্য বিধেয়তে।

সামাজিক, ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক স্বার্থ যখন পত্রিকা দিয়ে আর হাসিল করা সম্ভব হচ্ছে না, তখন একের পর এক পত্রিকা বন্ধ হতে থাকে। কোনও কোনোটি কুপি বাতির মতো জ্বালিয়ে রাখা হয়, শুধু প্রকাশক ও সম্পাদকের ইজ্জত জিইয়ে রাখতে। পত্রিকা যখন নিজ মেজাজে চলতে পারে না, তখন কাঁচি নেমে আসে সাংবাদিকদের দিকে। শুরু হয় ছাঁটাই। তারপরও কুলিয়ে উঠতে না পারলে পত্রিকাতেই তালা। শুধু ছোট উদ্যোক্তা নয়, বড় শিল্পগোষ্ঠীর মধ্যেও দেখা গেছে একই খাসিলত।

বেসরকারি টেলিভিশন যাত্রা শুরু করলে সেখানেও ছিল তারুণ্যের উচ্ছল উপস্থিতি। তারুণ্যের ওপর ভর করেই দর্শকপ্রিয়তা পায় বেসরকারি টেলিভিশন। কিন্তু ২০০৫ সাল থেকে টেলিভিশন চ্যানেলের বাম্পার ফলন দেখা দেয়। রাজনীতি বা ক্ষমতা-ঘনিষ্ঠ মানুষ ও শিল্পগোষ্ঠী টেলিভিশনের মালিকানা পেয়ে যায়। ক্ষমতায় আসন পাকাপোক্ত করতে রাজনীতিবিদরা এবং শিল্পগোষ্ঠীদের কেউ কেউ তাদের ‘অ্যালসেশিয়ান’-এর বিকল্প হিসেবে টেলিভিশনে বিনিয়োগ করে। টেলিভিশনের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই খাতে কলাকুশলীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। পত্রিকা থেকে যেমন অনেকে এসে টেলিভিশনের সঙ্গে যুক্ত হলো, তেমনি শিক্ষাজীবন শেষ করে তরুণরা আকর্ষণীয় পেশা হিসেবেও বেছে নিতে থাকে টেলিভিশনকে। সরকারের আসা যাওয়ায় টেলিভিশনের সংখ্যা গিয়ে ৩৩-এ পৌঁছে। আরও কয়েকটি নাকি জঠরে আছে। শিগগিরই জন্ম নেবে।

পত্রিকার মতোই টেলিভিশন সম্প্রচারে আনা হয়েছে কোনও মাঠ জরিপ ও ব্যবসায়িক সম্ভাব্যতা যাচাই না করে। তাই শুরুতে ঢাকঢোল বাদ্য বাজিয়ে সম্প্রচারে এলেও অল্প সময়ের মধ্যেই বেশিরভাগ চ্যানেল চুপসে যায়। রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক ফায়দা মূল লক্ষ্য থাকায়, এই মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত কুশীলবদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে যেমন বিনিয়োগ করা হয়নি, তেমনি টেলিভিশনকে দর্শকের কাছে পৌঁছানোর পরিকল্পনা, তাগিদ, বিনিয়োগ কোনোটিই ছিল না অধিকাংশ চ্যানেলের। বিশেষ করে ভারতীয় চ্যানেলের আগ্রাসনে নিজেকে টিকিয়ে রাখার কোনও প্রস্তুতি বা পরিকল্পনার স্বাক্ষর রাখতে পারেনি পাঁচমিশালী চ্যানেলগুলো।

সংবাদভিত্তিক চ্যানেল নিয়েও দর্শকের মাঝে আছে বিশ্বাসের দোদুল্যমানতা। এই বাস্তবতায় টেলিভিশন মাধ্যমটি এখন সংকটাপন্ন। আক্রান্ত দুরারোগ্য ব্যাধিতে। সহকর্মীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া স্ট্যাটাস থেকে অনেকেরই জানা হয়ে গেছে—কমপক্ষে দুই থেকে পাঁচ বছর ধরে ইনক্রিমেন্ট বন্ধ,এক থেকে তিন মাসের বেতন বকেয়া ৮ থেকে ১০টি চ্যানেলে, ছয় মাসের বেতন বকেয়া দুটি চ্যানেলে। গত এক বছরে ৯টি চ্যানেলে জনবল ছাঁটাই হয়েছে। বার্তা বিভাগ বন্ধ হয়েছে একটি চ্যানেলে। ত্রিশটি টিভি চ্যানেলের ২৮টিতে নেই গ্র্যাচুইটি। ২৫টিতে নেই প্রফিডেন্ট ফান্ড। কোনও কোনও চ্যানেলের সহকর্মীরা অবশ্য বুক ফুলিয়ে বলছেন তারা ভালো আছেন। কিন্তু নিজে একা ভালো থেকে বাকি চ্যানেলের সহকর্মীরা খারাপ থাকলে নিজের ভালো থাকার ‘টেকসই’ নিশ্চয়তা কতটুকু? বরং প্রবল ঝুঁকির মধ্যেই আছে এই শিল্প। সবাই মিলে ভালো থাকার পরিবেশ তৈরি না হলে এই আত্মপ্রসাদ মিথ্যে।

গণমাধ্যমের অনুমোদনের ক্ষেত্রে আমরা জানি নানা ‘ঘাট’ পেরিয়ে আসতে হয়। যারা সেই ঘাটে বসে আছেন যাচাই বাছাইয়ের দায়িত্বে, তাদের কাছে বিনীত আর্জি—পত্রিকা, বেতার, টেলিভিশন যাই হোকে না কেন, আবেদনকারীর ব্যবসায়িক ও মানসিক মুরোদ যাচাই করবেন। শুধু সামাজিক ও রাজনৈতিক তাপমাত্রা বিবেচনায় রাখবেন না। ছোট এই শিল্পকে রোগে ভুগতে দিলে সামাজিক অসুখ বাড়বে। আমরা সবাই মিলে ভালো থাকতে চাই। সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন।

লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি

স্ব.বা/শা

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *