স্বদেশবাণী ডেস্ক: পৌরসভা নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন (ইসি) যথাযথ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, নির্বাচন কমিশনের অগাধ ক্ষমতা থাকলেও তারা তা সুচারুভাবে পালন করতে পারেনি। মানুষ মরে যাচ্ছে, গুলি করছে, ব্যালট ছিনতাই হওয়ার পরও কমিশনের কোনো বিকার নেই। নির্বাচন কমিশন যে অকার্যকর, এই ভোটে তা ফের প্রতীয়মান হয়েছে।
বিশ্লেষকদের আরও অভিমত, পৌর নির্বাচন সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেনি। ক্ষমতাসীন দল প্রশাসনের সহায়তায় প্রভাব বিস্তার করেছে। অন্যদিকে বিএনপির মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল বলে মনে হয়েছে। আগামী নির্বাচনও এরচেয়ে ভালো কিছু হবে বলে আশা করছেন না তারা।
শনিবার দ্বিতীয় ধাপে সারা দেশে ৬০টি পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভোটে নানা অনিয়মের অভিযোগ করে বিএনপি। অনেক জায়গায় ককটেল বিস্ফোরণ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়িতে হামলা, দুই গ্রুপের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। নির্বাচনের পরও অনেক এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনা হয়। সিরাজগঞ্জে একজন নির্বাচিত কাউন্সিলর ছুরিকাঘাতে খুন হন।
এ নির্বাচন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রোববার যুগান্তরের কাছে পৃথকভাবে প্রায় একই সুরে উল্লিখিত মন্তব্য করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক এবং টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচন নিয়ে কিছু বলতে এখন বিব্রতবোধ করি। চোখের সামনে নির্বাচন কমিশনের মতো একটা প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস হতে দেখলাম।
এমনিতে আমাদের কোনো প্রতিষ্ঠান শক্তভাবে দাঁড়ায়নি। নির্বাচন কমিশন যতটু নড়বড়ে ছিল, তা এখন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। মানুষ মরে যাচ্ছে, গুলি করতেছে, মেরে ফেলতেছে অথচ নির্বাচন কমিশনের কোনো বিকার নেই। তারা মনে করছে, আমি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছি এখন মারামারি কর, পিটাপিটি কর যা খুশি তাই কর। নির্বাচন শেষ হলেই তাদের দায়িত্ব শেষ।
তিনি বলেন, নির্বাচন নিয়ে যদি কিছু বলি তাহলে বলব, বাংলাদেশে নির্বাচন শব্দটা হয়ে গেছে টাকা পয়সা, ধনদৌলত উপার্জনের একটা মেশিন। নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ হয়ে গেছে ‘থ্রি এম’-মানি, মাসল আর মেনিপুলেশন। নির্বাচন কমিশনের কাজ হলো পোস্ট অফিসের মতো সিল মেরে দেওয়া।
অনেকটা আক্ষেপ করে সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, বিচার বিভাগ ছাড়া বাংলাদেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা দেওয়া আছে নির্বাচন কমিশনের হাতে। উপমহাদেশের কোনো দেশের নির্বাচন কমিশনের হাতে এমন ক্ষমতা নেই।
একজন প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করার ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু সেগুলো কাগজে থাকলে তো লাভ হবে না। একজন কাউন্সিলরকে মেরে ফেলছে, আরেকজনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে; কিন্তু সেখানে নির্বাচন বন্ধ হয়নি বা কারও প্রার্থিতা বাতিল হয়নি। তাহলে আইন থেকে লাভ কি, যদি তার ব্যবহার না হয়।
রাজনৈতিক দলের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশে সত্যিকার অর্থে কোনো রাজনৈতিক দল আছে? বিএনপি বলতে কোনো দল আছে যাদের রাজনৈতিক কোনো চিন্তাভাবনা আছে। দেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্র নিয়ে তাদের মাথাব্যাথা আছে? নেই। আওয়ামী লীগ যে আদর্শ নিয়ে গঠিত হয়েছিল সেটা কি আছে? সবকিছুই ক্ষমতাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে।
এখন ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতা কাউন্সিলর বা মেয়র হওয়ার জন্য পাঁচ কোটি টাকা পকেটে নিয়ে মনোনয়ন পেতে নেমে পড়েন। মনোনয়ন পেলেই উনি মনে করেন জিতে গেছেন। উনি ওনার লোকজনকে ডেকে বলেন, আপনারা আমার সামনে সিল মারবেন। তাহলে কি বলা যায়, এ দলে কোনো নীতি বা আদর্শ আছে। যে দলটি দেশ স্বাধীন করল তাদের নীতি কি এখন কোনো নেতা মানছেন।
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, দেশে প্রচুর উন্নয়ন হয়েছে। আমরা গর্ব করতে পারি। কিন্তু এ উন্নয়নের জন্য একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই ক্রেডিট দিতে পারি। শেখ হাসিনা ছাড়া ২৫ ভাগ নেতাও জিততে পারবে না। কারণ, মানুষের সঙ্গে এদের কোনো যোগাযোগ নেই। যে যত বড় কথাই বলুক। সবকিছু চলছে শেখ হাসিনার নামে। দেশের উন্নয়ন হলেও গণতান্ত্রিক উন্নয়ন হয়নি। তাই সামনের নির্বাচনেও ভালো কিছু আশা করা যায় না।
বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, প্রথম দফার চেয়ে দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিঃসন্দেহে বেশি ছিল। এটা ভালো। কিন্তু নির্বাচনেও অনিয়মও বেশি হয়েছে। আর এখন অনিয়মগুলো আমাদের সহনীয় হয়ে গেছে। এগুলো আমরা মেনে নিই। ফলে এখন আর অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ বা আপত্তি আগের মতো হয় না। অনিয়ম হয়েছে, এটাকে আমরা খুব খারাপ চোখে দেখি না।
তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হলো অবাধ ও সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। কিন্তু এ দায়িত্ব এই নির্বাচন কমিশন, কোনো নির্বাচনেই সুচারুভাবে পালন করেছে-এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা থাকলেও তারা তা পালন করতে পারেনি। এর মূল কারণ হলো, স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও প্রার্থী কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচিত হয়। কিন্তু অন্যান্য দেশে এটা স্থানীয়রা নির্বাচিত করে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতাটা এত কেন্দ্রীভূত, এ জন্য তারা কোনোভাবেই নিজেদের গণতান্ত্রিক দাবি করতে পারে না।
শাহদীন মালিক বলেন, আগামী নির্বাচনেও এর চেয়ে ভালো কিছু আশা করা যায় না। বিগত নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বেশি হওয়ায় সহিংসতা বেশি হয়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগের একচেটিয়া বিজয় হয়েছে। আমার মনে হয়, এসব দেখে পরবর্তী ধাপে ভোটার সংখ্যা কমে যাবে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পৌর নির্বাচনে খুব বেশি সংঘাত হয়েছে সেটা বলা যাবে না। তবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে কমিশন তাদের ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করতে পারেনি। কিছু এলাকায় শান্তিপূর্ণ হলেও কয়েক এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। একজন নির্বাচিত কাউন্সিলরকে হত্যা করা হয়েছে, আরেকজন কাউন্সিলর প্রার্থীর মরদেহ পাওয়া গেল।
নির্বাচনি বিধি লঙ্ঘনের যেসব ঘটনা ঘটেছে সে ক্ষেত্রে ইসি তাদের ভূমিকা পালন করতে পারেনি। নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে মানুষের মনে যে ধারণাটা বদ্ধমূল-এটা একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠান সেটা পুনরায় প্রতীয়মান হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভোটে ইতিবাচক দৃষ্টান্তও চোখে পড়েছে। সে ক্ষেত্রে হয়তো স্থানীয় প্রশাসন যথাযথ ভূমিকা পালন করেছে।
রাজশাহীসহ আরও কয়েকটি এলাকায় সহিংসতার ঝুঁকি ছিল; কিন্তু প্রশাসনের তৎপরতায় কোনো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। প্রশাসন তৎপর হলে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, তা আবারও প্রমাণ হলো। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে পারেনি। সরকার কোথাও কোথাও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করলেও সব ক্ষেত্রে তা করতে পারেনি।
তিনি বলেন, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে সরকারি দলের একটা ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু তারা সেটা পালন করতে পারেনি। তাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। প্রশাসনের সহায়তায় ক্ষমতাসীনরা অনেক জায়গায় প্রাধান্য বিস্তার করেছে। এমনকি তারা নির্বাচন কমিশনেরও সহায়তা পেয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের বাইরে যারা, তারা অনেকটা কোণঠাসা অবস্থায় ছিল।
বিশেষ করে বিএনপির ভূমিকাটা আরও স্বয়ংক্রিয় হতে পারত। দলটির মনে হচ্ছে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ছিল। প্রচার-প্রচারণায় বিএনপির নেতাকর্মীরা সরব থাকলেও ভোটের দিন তাদের উপস্থিতি ততটা ছিল না। হয়তো তারা শঙ্কার মধ্যে ছিল। সামনের নির্বাচনেও এই কমিশন ভালো নির্বাচন দিতে পারবে বলে আশা করা যায় না। তবে এবারের নির্বাচন থেকে তারা শিক্ষা নিলে হয়তো কিছুটা ভালো করতে পারবে।