স্বদেশবাণী ডেস্ক: জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যা মামলায় আট আসামির প্রত্যেককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তারা সবাই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য।
বুধবার ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি প্রত্যেক আসামিকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।
মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের গলায় ফাঁসি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখার নির্দেশ দেন বিচারক। আদালতের ৩৬ কার্যদিবসে চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় ঘোষণা করা হলো।
এছাড়া রায়ের পর্যবেক্ষণে ‘যারা বই প্রকাশের দায়ে মানুষ হত্যা করতে পারে তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রু’ বলে উল্লেখ করেন বিচারক।
প্রকাশক দীপন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের ছেলে।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হল- মইনুল হাসান শামীম, মো. আব্দুস সবুর, খাইরুল ইসলাম, মো. আবু সিদ্দিক সোহেল, মোজাম্মেল হোসেন সায়ম, মো. শেখ আব্দুল্লাহ, চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ও আকরাম হোসেন।
এদের মধ্যে প্রথম ছয়জন কারাগারে ও শেষের দুজন পলাতক। রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটের ৩য় তলায় ‘জাগৃতি’ প্রকাশনী অফিসে ঢুকে কতিপয় সন্ত্রাসী ধারালো অস্ত্র দিয়ে দীপনের ঘাড়ের পেছনে আঘাত করে হত্যা করে।
২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর আনুমানিক বেলা সাড়ে ৩টা থেকে ৩টা ৫০ মিনিটের মধ্যে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার ৫ বছর ৩ মাস ৭ দিন পর এ রায় ঘোষণা করা হলো।
রায় ঘোষণার আগে কারাগারে থাকা ছয় আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। রায় ঘোষণার পর তাদের মৃত্যু পরোয়ানা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। আর পলাতক দুই আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
রায় উপলক্ষ্যে বুধবার আদালত চত্বরে পুলিশি নজরদারি বাড়ানো হয়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আসামিদের ট্রাইব্যুনালে তোলা হয়। দুপুর ১২টার দিকে আদালত রায় পাঠ শুরু করেন।
৫৩ পাতার রায়ের কিছু অংশ পাঠ করে শোনান বিচারক। রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আদালতে উপস্থিত দীপনের স্ত্রী ডা. রাজিয়া রহমান কান্নায় ভেঙে পড়েন। পাশে থাকা আত্মীয়রা তাকে সান্ত্বনা দেন।
রায় শুনে তিনি সৃষ্টিকর্তা ও আদালতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। রাজিয়া রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আমি খুবই অসুস্থ। গতকাল আমার মা মারা গেছেন। এ রায়ে আমি সন্তুষ্ট।
এ রায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এখন দ্রুত রায় কার্যকর হওয়াই একমাত্র প্রত্যাশা।
রায়ে দীপনের পরিবারের পাশাপাশি ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর গোলাম ছারোয়ার খান জাকির ও ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান কৌঁসুলি মো. আব্দুল্লাহ আবু সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।
অপরদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী খাইরুল ইসলাম লিটন ও এম নজরুল ইসলাম এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাবেন বলে জানিয়েছেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণ : ট্রাইব্যুনালের বিচারক রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন- লেখক, ব্লগার ও প্রকাশকদের হত্যার অংশ হিসাবে অভিজিত রায়ের বই প্রকাশের জন্য জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে হত্যা করা হয়।
দীপনকে হত্যার জন্য আসামিদের মধ্যে চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক নির্দেশ, প্রশিক্ষণ ও মূল হত্যাকারীদের অর্থায়ন করে। আর পরিকল্পনা করে আসামি আকরাম হোসেন।
আসামি মইনুল হাসান শামীম অস্ত্র সংগ্রহ, খুনের পরামর্শ ও মূল হত্যাকারীদের দিকনির্দেশনা ও নেতৃত্ব দেয়। আসামি মোজাম্মেল হোসেন সায়ম খুনের পরিকল্পনায় অংশগ্রহণসহ ঘটনাস্থল রেকি করে।
আসামি মো. আব্দুস সবুর হত্যাকারীদের প্রশিক্ষণ দেয়। আসামি মো. আবু সিদ্দিক সোহেল এবং খাইরুল ইসলাম ঘটনাস্থল রেকি করে।
আসামি মো. শেখ আব্দুল্লাহ অর্থ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে আনা-নেয়া করে হত্যাকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কাজেই আসামিদের কারও ভূমিকা ছোট-বড় করে দেখার সুযোগ নেই।
যারা বই প্রকাশের দায়ে মানুষ হত্যা করতে পারে তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রু। দীপন হত্যার প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণকারী অপরাধীরা বেঁচে থাকলে আনসার আল ইসলামের বিচারের বাইরে থাকা সদস্যরা একই অপরাধ করতে উৎসাহিত হবে।
যেহেতু আসামিরা আনসার আল ইসলামের সদস্য হিসাবে সাংগঠনিকভাবে দীপনকে হত্যা প্রচেষ্টায় অশংগ্রহণ করেছে। সেজন্য তাদের একই সাজা প্রদান করাই হবে বাঞ্ছনীয়। কাজের ওই আসামিরা কোনো সহানুভূতি পেতে পারে না।
তাই আসামিদের প্রত্যেককে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেই ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে এবং এটা হবে একটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।
এতে একদিকে নিহতের আত্মীয়রা মানসিক শান্তি পাবেন এবং অন্যদিকে ভবিষ্যতে এ ধরনের জঘন্য অপরাধ করতে অন্যরা ভয় পাবে এবং নিরুৎসাহিত হবে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, আনসার আল ইসলামের সদস্যরা সাভারে ব্লগার রিয়াদ মোর্শেদ বাবুকে হত্যা করে।
একই দিনে শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে একং লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর প্রকাশক টুটুলের ওপর হত্যার উদ্দেশ্যে এসব সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়।
জিহাদের অংশ হিসাবে নিষিদ্ধ সংগঠন আনসার আল ইসলাম বা আনসার উল্লা বাংলা টিমের সদস্যদের তথা এ মামলার আসামিদের লক্ষ্য ছিল ব্লগার, লেখক ও প্রকাশকদের হত্যা করে মানুষের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়া।
একই সঙ্গে মানুষের মনে আতঙ্ক তৈরি করে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করা। আর এসবের উদ্দেশ্যে হলো মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বন্ধ করে দেওয়া। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ধ্বংস করে দেওয়া।
হত্যা মামলা, তদন্ত ও বিচার : ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর প্রকাশক দীপনকে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনায় ওই বছরের ২ নভেম্বর দীপনের স্ত্রী ডা. রাজিয়া রহমান বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় মামলাটি করেন।
তদন্ত শেষে ২০১৮ সালের ১৬ অক্টোবর আদালতে মামলার চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেওয়া হয়। তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির সহকারী পুলিশ সুপার মো. ফজলুর রহমান মামলার চার্জশিট দাখিল করেন।
চার্জশিটে ওই আট আসামিকে অভিযুক্ত করা হয়। ২০১৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ওই চার্জশিট আমলে নেন আদালত। একই বছরের ১৩ অক্টোবর আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ (অভিযোগ) গঠন করেন।
২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। মামলায় ২৩ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন।
এরপর রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে ২৪ জানুয়ারি আদালত এ মামলার রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য করেন।