বাংলাদেশ হবে বিশ্ব শান্তি, সংস্কৃতি ও মানবতার অগ্রদূত

জাতীয়

স্বদেশবাণী ডেস্ক: একটি ঘটনা বলি। আমার ভাইঝির বয়স তখন ১৮ বছর, লিউকেমিয়া ধরা পড়ল তার। সে রক্তশূন্যতায় ভুগছিল। তাৎক্ষণিক চিকিৎসা শুরু করলেও পরবর্তীতে এটা ব্লাড-ক্যান্সারে রূপ নিল। যার একমাত্র উপায় বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট (অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন)। তখন বোনম্যারো ডোনার পাওয়া এতটা সহজ ছিল না।

সপরিবারে তারা আমেরিকায় থাকত। অনেক চেষ্টার পর টেক্সাসের একটি বোনম্যারো ব্যাংকে তার সাথে মিলছে এমন বোনম্যারোর সন্ধান পাওয়া গেল। তার অপারেশনও হলো। অথচ আমরা তখনো জানতাম না— এটা কে ডোনেট করেছেন। তিন বছর পর তার পরিচয় জানতে পারি, তিনি ছিলেন একজন হিন্দু যুবক।

অপারেশনের পর আমার ভাইঝির কেমোথেরাপি চলছিল। বিভিন্ন রকম ওষুধও খেতে হতো তাকে। এসব কারণে তার কিডনি দুটি অকেজো হয়ে গেল। নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হচ্ছিল। কিডনি প্রতিস্থাপন করার জন্যেও কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না। কোনো উপায় না পেয়ে সে নিজেই বিভিন্ন জায়গায় ই-মেইল করে জানাল, আমার জীবন ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে, কেউ কি একটি কিডনি ডোনেট করবেন?

কিছুদিনের মধ্যে মেয়েটির থেকে পাঁচ বছরের ছোট একটি ছেলে ই-মেইলের জবাব দেয়। এই ছেলেটি ছিল আফ্রো-আমেরিকান খ্রিষ্টান পরিবারের সদস্য। তার বাবা নেই, মা গীর্জায় ধর্মীয় সঙ্গীত গেয়ে জীবিকা অর্জন করেন। সে-ও গীর্জায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করে। এতে তার পড়াশোনার খরচটা হয়ে যায়। এই ছেলেটিই তার কিডনি দান করতে রাজি হয় এবং স্রষ্টার করুণায় সফলভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। আমার ভাইঝি আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে ওঠে। প্রথমে ক্যান্সার, পরবর্তীতে কিডনি প্রতিস্থাপন— এ দীর্ঘ চিকিৎসায় তার যে স্বাস্থ্যহানি হয়েছিল, তা-ও পুরোপুরি সেরে যায়। পরবর্তীতে আমার ভাইঝি এমবিএ করে যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে। বর্তমানে কাজ করছে নিউইয়র্কের একটি ক্যান্সার হাসপাতালের ক্যাম্পেইন ম্যানেজার হিসেবে।

ভেবে দেখুন, অচেনা-অজানা একজন মুসলিম মেয়েকে সনাতন যুবকটি বোনম্যারো ডোনেট করে এবং একজন খ্রিষ্টান ছেলে কিডনি দিয়ে সাহায্য করে। এতে প্রমাণ হয় যে, মানবিকতার স্থান ধর্মবর্ণের অনেক ওপরে।

আমি খুবই আনন্দিত, কোয়ান্টামের স্বেচ্ছা রক্তদাতা সম্মাননার এ অনুষ্ঠানে আপনারা যারা রক্তদাতা এখানে আছেন, তারা নিঃস্বার্থভাবেই রক্ত দিচ্ছেন। আপনার রক্ত কে পাবে বা কোন গোত্রের লোক পাবে, সেটা আপনারা দেখেন না। এখানে এসে আমি মুগ্ধ হয়েছি যে, আমাদের দেশে এতজন মানুষ মানবসেবায় নিয়োজিত আছেন। আপনারা সত্যিকার অর্থেই আশরাফুল মাখলুকাত হওয়ার প্রচেষ্টায় আছেন। আমি খুবই আপ্লুত। কোয়ান্টামের কোনো অনুষ্ঠানে এর আগে আমার আসা হয় নি। কোয়ান্টামের সাথে আমার পরিচয় অতিসাম্প্রতিক। অনেক ভালো কাজের পাশাপাশি আপনারা রক্তদানের মাধ্যমে মানুষকে সেবাদান করছেন। মানুষকে উজ্জীবিত রাখছেন। কিন্তু খুবই দুঃখের বিষয়, সাম্প্রতিককালে সারা বিশ্বে যুদ্ধ-সংঘাত, সন্ত্রাস, মারামারি-কাটাকাটি লেগেই আছে। যার ফলে লোকজন কর্মক্ষেত্র, বসতবাড়ি, নিজেদের ঐতিহ্য থেকে বিতাড়িত হচ্ছে। শরণার্থী হয়ে বিভিন্ন দেশে বিতাড়িত হচ্ছে। এবছর (২০১৭) বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ শরণার্থী হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এত অল্প সময়ে ছয় কোটির বেশি মানুষ উদ্বাস্তু হয় নি। আমরাও একসময় শরণার্থী হয়েছিলাম, সেই ১৯৭১ সালে। বাধ্য হয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তবে আমাদের আশা ছিল, আমরা ফিরে আসব। ইদানীং যারা শরণার্থী হচ্ছে, তাদের অনেকের সে আশাটাও নেই।

পৃথিবীব্যাপী এ সংঘাতের মূল কারণ হচ্ছে অন্ধত্ব, অজ্ঞতা। পারস্পরিক অসহিষ্ণুতা যেমন বেড়ে গেছে, তেমনি বেড়েছে অন্যের প্রতি সম্মানবোধের অভাব। এই হত্যাযজ্ঞ ও সংঘাত থেকে পৃথিবীকে সুন্দর করতে চাইলে আমাদের সহিষ্ণু মনোভাব গড়তে হবে। সবাইকে সমান মর্যাদা দিতে হবে। সব মানুষই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি সবকিছুর ঊর্ধ্বে চাই এই মন-মানসিকতা, এই বিশ্বাসেই যেন আমরা বিশ্বাসী হই।

বাংলাদেশকেই এ-ক্ষেত্রে পৃথিবীর নেতৃত্ব দেয়া উচিত। কারণ আমেরিকা আবিষ্কৃত হয় ১৪৯২ সালে। ইউরোপের রেনেসাঁ শুরু হয় ১৭শ খ্রিষ্টাব্দে। কিন্তু তার বহু আগে, ইউরোপে রেনেসাঁরও প্রায় ছয়শ বছর আগে, বাংলার কবি চণ্ডীদাস গেয়েছিলেন সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। মানবিকতার জয়গান গাওয়া হয়েছে এদেশের সর্বত্রই। কাজী নজরুল ইসলাম গেয়েছেন : গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান। এজন্যেই আমাদের দেশ একদিন হবে সারা বিশ্বে শান্তি, সংস্কৃতি ও মানবতার অগ্রদূত।

এই মানবিক বিষয়গুলো আমরা স্কুল-কলেজ এবং বাড়িতে শিখেছি। আমাদেরই এ বিষয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে। শান্তি, সংস্কৃতি ও মানবিকতার এই আন্দোলন আবারো আমাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। এটা সরকারের বা কোনো ব্যক্তিবিশেষের একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। আমি আপনাদের কাছে এ ব্যাপারে সাহায্য চাই। কারণ আপনাদের যে ধরনের মন-মানসিকতা তাতে মনে হয়, কোয়ান্টামের মতো প্রতিষ্ঠানকেই এ-কাজে এগিয়ে আসতে হবে।

কোয়ান্টাম রক্তদাতা সম্মাননার অনুষ্ঠানের বক্তব্য থেকে অনুলিখন, ৬ আগস্ট ২০১৭।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *