অগ্নিঝরা মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রতীক্ষায় দেশ ও বহির্বিশ্ব

জাতীয় লীড

স্বদেশবাণী ডেস্ক: দিন যতই গড়াচ্ছে অসহযোগ আন্দোলনের গন্তব্য ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় সাড়ে সাত কোটি বাঙালির একটাই প্রতীক্ষা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে কী ভাষণ দেবেন। সব জায়গায় জল্পনা-কল্পনা চলছে বঙ্গবন্ধু কী বলেন। সেটা শোনার জন্য সারা দেশের মানুষ ও আন্তর্জাতিক মহল অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ। ওইদিন ঢাকায় লাগাতার ছয় দিনের হরতাল পালনকালে সর্বস্তরের জনতা রাস্তায় নেমে আসে।

শহিদ জননী জাহানার ইমাম তার ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ নিয়ে লিখেছেন, ‘আগামীকাল রেসকোর্সে গণজমায়েতে শেখ সাহেব কী বলবেন, তা নিয়েও লোকজনের জল্পনা-কল্পনার অবধি নেই। এক তারিখে হোটেল পূর্বাণীতে তিনি বলেছিলেন, বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের কর্মসূচির ঘোষণা তিনি সাত তারিখে দেবেন। কিন্তু এ কদিনে ঘটনা তো অন্য খাতে বইছে। এত মিছিল, মিটিং, প্রতিবাদ, কারফিউ ভঙ্গ, গুলিতে শত শত লোক নিহত- এর প্রেক্ষিতে শেখ সাহেব আগামীকাল কী ঘোষণা দেবেন? কেউ বলছে, উনি আগামীকাল স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। কেউ বলছে, দুর তা কী করে হবে? উনি নির্বাচনে জিতে গণপ্রতিনিধি, মেজরিটি পার্টির লিডার, উনি দাবির জোরে সরকার গঠন করবেন, স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করবেন। এখন স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে সেটা তো রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়বে। কেউ বলছে, আগামীকাল মিটিংয়ের ব্যাপারে ভয় পেয়ে ইয়াহিয়া আজ ভাষণ দিচ্ছে।’

এদিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দুপুরে এক বেতার ভাষণে ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। ভাষণে তিনি বলেন, যাই ঘটুক না কেন, যতদিন পর্যন্ত পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আমার হুকুমে রয়েছে এবং আমি পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান রয়েছি ততদিন পর্যন্ত আমি পূর্ণাঙ্গ ও নিরঙ্কুশভাবে পাকিস্তানের সংহতির নিশ্চয়তা বিধান করব। এ সময় তিনি ১০ মার্চ রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসার আহ্বান জানান।

প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের অব্যবহিত পরই বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাখার ওয়ার্কিং কমিটির এক যুক্ত জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী এই রুদ্ধদ্বার বৈঠকে প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের আলোকে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। আলোচনা শেষে ইশতেহারে বঙ্গবন্ধু বলেন, শহীদদের রক্ত মাড়িয়ে তিনি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন না।

ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণের পরপরই ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেশ কয়েকটি প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। রাওয়ালপিণ্ডির পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণকে স্বাগত জানিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তার দল ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনের আগেই আলোচনার মাধ্যমে শাসনতন্ত্রের মোটামুটি একটি কাঠামো স্থির করতে চায়।

পেশোয়ারে পাকিস্তান মুসলিম লীগ প্রধান খান আবদুল কাইয়ুম খান ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানিয়ে বিবৃতিতে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পিডিপি প্রধান নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান ও কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মমতাজ দৌলতানা ইয়াহিয়া খানের ঘোষণাকে স্বাগত জানান।

অন্যদিকে লাহোরে কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা এয়ার মার্শাল নূর খান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ শাসনের বৈধ অধিকার রয়েছে। ক্ষমতা হস্তান্তরের সব বাধা অবিলম্বে দূর করতে হবে। প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণে পরিস্থিতি অবনতির জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর দোষারোপ করায় নূর খান দুঃখ প্রকাশ করেন।

৬ মার্চ সকাল ১১টার দিকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের গেট ভেঙে ৩৪১ জন কয়েদি পালিয়ে যায়। পালানোর সময় পুলিশের গুলিতে ৭ জন কয়েদি নিহত এবং ৩০ জন আহত হয়। রাজশাহীতে মিছিলকারীদের ওপর সশস্ত্র বাহিনীর গুলিতে ১ জন নিহত ও ১৪ জন আহত হয়, সান্ধ্য আইন অব্যাহত থাকে। খুলনায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও গুলিবর্ষণে ১৮ জন নিহত ও ৮৬ জন আহত হয়।

ওইদিনের (৬ মার্চ) স্মৃতিচারণ করে যুগান্তরে প্রকাশিত এক নিবন্ধে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও জ্যেষ্ঠ নেতা তোফায়েল আহমেদ লেখেন, ‘সারা দেশে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। বিগত কয়েকদিনে সেনাবাহিনীর নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সর্বস্তরের মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিকসহ সবাই স্ব স্ব অবস্থান থেকে প্রতিবাদ মিছিলে শামিল হতে থাকেন।

তিনি আরও লেখেন, “এদিন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক শাসক লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে সরিয়ে তদস্থলে ‘বেলুচিস্তানের কসাই’খ্যাত লে. জেনারেল টিক্কা খানকে উভয় পদে নিযুক্ত করার ঘোষণা দেওয়া হয়। ৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠকের পর ফের ৬ মার্চ অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান দ্বিতীয় দফা বৈঠক করেন। বৈঠকের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, পরিস্থিতি রক্ষা করার জন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। বাকি বিষয় আগামীকাল শেখ মুজিবের বক্তৃতায় জানতে পারবেন।”

সূত্র : মার্চ ৭, ১৯৭১, ইত্তেফাক; যুগান্তর আর্কাইভ; জাহানারা ইমামের লেখা বই ‘একাত্তরের দিনগুলি’

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *