সংসদ অধিবেশন পাঁচ ইস্যুতে উত্তাপ ছড়িয়েছে

জাতীয় লীড

স্বদেশবাণী ডেস্ক: সরকারের আমলানির্ভরতা, স্বাস্থ্য খাতের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি, অর্থ পাচার, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বেশ কয়েকটি ইস্যুতে উত্তাপ ছড়িয়েছে এবারের সংসদ। স্বাস্থ্য খাতের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সমালোচনা করতে গিয়ে করোনা মেকাবিলায় সীমাহীন ব্যর্থতার অভিযোগে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের পদত্যাগের দাবিও ওঠে সংসদে। অর্থ পাচার ঠেকাতে না পারার কারণে তোপের মুখে পড়তে হয় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকেও।

পাশাপাশি বাজেট আলোচনার সময় অধিবেশনে তার অনুপস্থিতি নিয়েও কথা হয়। এর বাইরেও ঋণখেলাপিদের সামাজিকভাবে বয়কট করা, টিকা কেনায় ধীরগতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া, ব্যাংকিং খাত এবং শেয়ারবাজারের দুরবস্থা নিয়েও বিরোধীদের সমালোচনায় ঝাঁঝালো হয়ে উঠেছিল সংসদের ত্রয়োদশ অধিবেশন।

শনিবার শেষ হয় একাদশ জাতীয় সংসদের ত্রয়োদশ অধিবেশন, যা ছিল একাধারে এ বছরের বাজেট অধিবেশনও। করোনা মহামারির মধ্যে দ্বিতীয় এই বাজেট অধিবেশন শুরু হয় ২ জুন। ৩ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২১-২০২২ নতুন অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন। গত ৩০ জুন তা পাশ হয়। সপ্তাহখানেক বিরতি দিয়ে টানা চার দিন ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনা চলে। সব মিলিয়ে ৮৫ জন সংসদ সদস্য এবার বাজেটের ওপর আলোচনায় অংশ নেন।

করোনায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরের অধিবেশনটি সংক্ষিপ্ত হলেও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে বিতর্কের কারণে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল এবারের সংসদ। মাত্র দশ কার্যদিবসের বাজেট অধিবেশনে আলোচনায় বেশির ভাগ সময় প্রাধান্য পায় আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক ইস্যু। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন ইস্যুতে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির সংসদ সদস্যরা সরকারের মন্ত্রীদের তুলাধোনা করেন। বিশেষ করে করোনা মহামারি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা, কেনাকাটাসহ নানা ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতি, রাজধানী ঢাকাসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে চিকিৎসা ব্যবস্থার সংকট নিয়ে বিরোধীদের আলোচনায় সরব ছিল সংসদ অধিবেশনের বেশির ভাগ সময়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল শিক্ষার ওপর ১৫ শতাংশ করারোপ প্রস্তাবের সমালোচনাসহ এই অধিবেশন চিত্রনায়িকা পরীমনি ইস্যু, ক্লাব, মদ, জুয়ার বিতর্কেও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল কিছু সময়ের জন্য।

এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ‘জাতীয় সংসদই হবে সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু, এমনটাই তো জনগণের প্রত্যাশা। সংসদে জনগণের সমস্যা নিয়ে আলোচনা হবে, তাদের দুঃখ-দুর্দশা তুলে ধরা হবে-সবাই এমনটাই আশা করেন। এবারের অধিবেশন ছিল মূলত বাজেট অধিবেশন। সংক্ষিপ্ত হলেও বিরোধী দলের সরব উপস্থিতির কারণে সংসদ অধিবেশন প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল এবার।

বিরোধী দলের সদস্যদের শানিত ও তীব্র আক্রমণের জবাব দিতে গিয়ে শাসক দল আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরাও কম যাননি। বাজেট আলোচনার সুযোগ নিয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং হেফাজতে ইসলামের তীব্র সমালোচনায় মুখর ছিলেন তারাও। তবে সব আলোচনাকে পেছনে ফেলে দিয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে ‘অতিমাত্রায় আমলানির্ভরতার’ অভিযোগ। খোদ সরকারি দলের ভেতর থেকেই যখন অভিযোগ আসে তখন তা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এর সঙ্গে যোগ হয় স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং আর্থিক খাতের কেলেঙ্কারি। জাতীয় পার্টি ও বিএনপির একাধিক এমপি সংসদে দাঁড়িয়ে করোনা মোকাবিলায় ব্যর্থতার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে তার পদত্যাগ দাবি করেন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফোন ধরেন না। তাকে ফোনে পাওয়া যায় না।’ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর ইস্যুতেও উত্তপ্ত হয় সংসদ। আগে ক্ষমা, তারপর মুক্তি-সে ফ জানিয়ে দেন সরকারের আইনমন্ত্রী। সংসদের এই বক্তব্য নিয়ে বেশ সরগরম হয়ে ওঠে দেশের রাজনীতির মাঠও।

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর তীব্র সমালোচনা অন্যরাও করেন জাতীয় সংসদে। বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ বলেন, কেনাকাটায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দুর্নীতির ডিপো। প্রয়োজনে টিকা আনা উন্মুক্ত করে দেওয়ারও দাবি জানান তিনি। জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন। নিজেদের সরকারের মন্ত্রীর সমালোচনা না করলেও করোনার ভ্যাকসিনের জন্য স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি-এই তিন ধরনের পরিকল্পনা নেওয়ার পরামর্শ দেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান। সংসদে তিনি বলেন, ‘টিকার জন্য স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। এর মধ্যে বিদেশ থেকে টিকা কিনে আনা এবং দেশে টিকা উৎপাদনের ব্যবস্থাও করতে হবে।’

অর্থ পাচার রোধ এবং ঋণখেলাপিদের লাগাম টেনে ধরতে না পারার অভিযোগে জাতীয় সংসদে তোপের মুখে পড়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও। ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত এবং শেয়ারবাজার নিয়ে বিরোধীদের সমালোচনার স্বীকার হন তিনিও। বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে দেশের টাকা-বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের এমন অভিযোগের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘নামগুলো আমাদের দেন। কাজটি করলে আমাদের জন্য সহজ হবে। এখনো অনেকেই জেলে আছেন, বিচার হচ্ছে। আগে যেমন ঢালাওভাবে চলে যেত, এখন তেমন নেই। কারা টাকা নিয়ে যায়, লিস্ট আমার কাছে নেই।’ ঋণখেলাপিদের সামাজিকভাবে বয়কটেরও দাবি ওঠে সংসদে। জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ও দলটির কো-চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় সংসদে এ দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘আমার মতে যারা ঋণখেলাপি, তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করা উচিত। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠানে তাদের আমন্ত্রণ জানানো ঠিক হবে না। বিশেষ করে যারা বড় বড় ঋণখেলাপি তারা যাতে বিলাসবহুল জীবনযাপন করতে না পারে সে ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। তাদের কাছে বিমান টিকিট বিক্রি নিষিদ্ধ করতে হবে। দামি গাড়ি থাকলে তার লাইসেন্স বাতিল করা উচিত। এছাড়া তাদের সব সম্পদ জব্দ করে ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা নিতে হবে।’

শেয়ারবাজারের দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরেন বিএনপি সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘আর্থিক খাতে অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্ব সঠিক। কর্তৃত্ব দুর্বল। ব্যাংকে তার কর্তৃত্ব নেই। কর্তৃত্ব না থাকলে অবাধে এসব হবে। এক ব্যাংকের পরিচালক আরেক ব্যাংকের টাকা নিচ্ছেন। টাকা নিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাঠাচ্ছেন। এসব দেখতে হবে।’

গলায় প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে বক্তৃতা দিয়ে আলোচনায় আসেন সরকারদলীয় সংসদ সদস্য এসএম শাহাজাদা। উপকূলবাসী ও নিজের উপকূলীয় নির্বাচনী অঞ্চলের মানুষদের দাবি বাস্তবায়নে বাজেট আলোচনার সময় ‘আর কোনো দাবি নাই-ত্রাণ চাই না বাঁধ চাই’ লেখা প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে বাঁধের দাবি জানান তিনি। এই স্বল্প সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ নানান ইস্যুতে জাতীয় সংসদে আলোচনা হয়। ফলে এবারের অধিবেশন প্রাণবন্ত থাকে পুরোটা সময়জুড়ে।

অবশ্য বিরোধী দলের সমালোচনার জবাবে সরকারি দলের সদস্যরাও পালটা আক্রমণ করেন। আওয়ামী লীগের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশে লুটপাটের রাজনীতি, ব্যাংক লুটপাটের হোতা কারা? তাদের নেতা জিয়াউর রহমান এটা শুরু করেছিলেন। খুন, গুমের শুরু করেছিলেন তিনি। সেনাসদস্যদের একসঙ্গে ৪ জন করে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেন জিয়াউর রহমান। জিয়া হ্যাঁ-না ভোট করেছিলেন। খালেদা জিয়া এক কোটি ৩০ লাখ ভুয়া ভোটার করেছিল। শেখ হাসিনার আন্দোলনের ফলেই ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যার সুফল আজ দেশবাসী ভোগ করছে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *