স্বদেশ বাণী ডেস্ক: রাজধানীর জিরো পয়েন্ট থেকে সদরঘাট পর্যন্ত যানজটের ফলে প্রতি কার্যদিবসে ভোগান্তিতে পড়েন ঢাকা কোর্টের বিচারক, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থী সাধারণ মানুষ। প্রতিকার চেয়ে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে ২০১২ সালে উচ্চ আদালতে একটি রিট দায়ের করে। শুনানি শেষে ট্রাফিক জ্যামের ভোগান্তি দূর করতে জিরো পয়েন্ট থেকে সদরঘাট পর্যন্ত ফুটপাত দখলমুক্ত করতে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
পাশাপাশি ভ্যান ও ঠেলাগাড়ি পার্কিং বন্ধ, রাস্তার পাশের ফুটপাত বা রাস্তায় দোকানের পণ্য রাখা বন্ধ, রাস্তা-ফুটপাতে যেন ফেরিওয়ালা ও ফলের দোকান বসতে না পারে-সেজন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়। কিন্তু সে নির্দেশনা গত ৯ বছরে বাস্তবায়ন হয়নি।
এমন অসংখ্য জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলায় সুপ্রিমকোর্টের উভয় বিভাগ যুগান্তকারী নির্দেশনা বা রায় দিলেও তা বাস্তবায়নের হার খুবই কম। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ ও সাধারণ মানুষ। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রতিনিয়তই উদাসীনতা, নিষ্ক্রিয়তা ও অবহেলার পরিচয় দিচ্ছে-এমন মন্তব্য আইন বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, এ অবস্থায় রায়গুলো বাস্তবায়নে মনিটরিং সেল গঠন করা প্রয়োজন। রাজনৈতিক মদদপুষ্ট প্রভাবশালীদের কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উচ্চ আদালতের নির্দেশনা তামিল করা সম্ভব হয় না। যত প্রভাবশালীই হোক, নির্দেশনা অমান্যকারীদের আইনের আওতায় আনা জরুরি। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে জনস্বার্থে করা মামলার স্বীকৃত কোনো পরিসংখ্যান নেই। পরিসংখ্যান প্রস্তুত করারও পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), চিলড্রেন চ্যারিটি ফাউন্ডেশন ছাড়াও বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কিছু সংগঠন এ ধরনের মামলা করছে। এছাড়া সুপ্রিমকোর্টের বেশ কয়েকজন আইনজীবী ব্যক্তিগতভাবেও এ ধরনের মামলা করে থাকেন।
জনস্বার্থে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। মানবাধিকার সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’-এর চেয়ারম্যান তিনি। জনগুরুত্বপূর্ণবিষয়ক মামলার আইনজীবী হিসাবে জনপ্রিয়তাও পেয়েছেন তিনি। পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। এ পর্যন্ত তিনি জনস্বার্থে মামলা করেছেন ২৯০টিরও বেশি। এসব মামলার মধ্যে এখনো পর্যন্ত ৮০টিরও বেশি মামলায় চূড়ান্ত রায় পেয়েছেন।
রায় বাস্তবায়নের বিষয়ে মনজিল মোরসেদ যুগান্তরকে বলেন, জনস্বার্থে মামলার কারণে অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। রায় বাস্তবায়ন এখনো চলমান। ‘সংবিধানে বলা আছে, প্রশাসন এবং জনগণ সবাই উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মানতে বাধ্য। তিনি বলেন, রায় বাস্তবায়ন না হলে সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা যায়। এ ছাড়া যে কেউ আদালত অবমাননার অভিযোগে মামলা করতে পারেন। কারণ সুপ্রিমকোর্ট একটা রায় দিলে সেটা ‘পাবলিক ডকুমেন্ট’ হয়ে যায়। প্রশাসনকে জনস্বার্থে মামলার নির্দেশনা কঠোরভাবে পালনে উদ্বুদ্ধ করা না গেলে কোনো চেষ্টাই সফলতার মুখ দেখবে না। জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, এই ধরনের মামলার রায় পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হলেও কিছুটা হচ্ছে। আস্তে আস্তে বাস্তবায়নের হার আরও বাড়বে।
মনজিল মোরসেদের যুগান্তকারী রিট আবেদনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-ঢাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা, জিরো পয়েন্ট থেকে সদরঘাট পর্যন্ত রাস্তায় অবৈধ দখল বন্ধ করে বিচারক ও আইনজীবীসহ বিচারপ্রার্থী মানুষের যাতায়াত সহজ করা, বিদ্যুৎ অপচয় বন্ধ করা, পাহাড়কাটা, জলাশয় ভরাট রোধ, সুচিত্রা সেনের বাড়ি উদ্ধার, বেগম রোকেয়ার বাড়ি থেকে গার্মেন্ট অপসারণ, কক্সবাজার ও কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত অবৈধ দখলমুক্ত করা, খাদ্য নিরাপত্তা, নদী-খাল উদ্ধার, পরিবেশ রক্ষা, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রক্ষা, বুড়িগঙ্গাসহ দেশের বৃহত্তর চার নদীরক্ষা, লালবাগ কেল্লাসহ ঐতিহ্যবাহী প্রত্নতত্ত্ব স্থাপনা সংরক্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, পুলিশের হাতে নির্যাতন, রাজধানীর সড়কে গরুর হাট, ২০ বছরের ঋণখেলাপি ও অর্থ পাচারকারীদের তালিকা চেয়ে নির্দেশনা এবং সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত।
বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাশ হয়। ‘বিচারকদের পদের মেয়াদ’সংক্রান্ত ষোড়শ সংশোধনী বিল অনুসারে, সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ২ দফায় বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতাসংক্রান্ত বিধান রাখা হয়। ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিমকোর্টের নয় আইনজীবী হাইকোর্টে জনস্বার্থে রিট দায়ের করেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে তিনজন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। রাষ্ট্রপক্ষের আপিল ২০১৭ সালের ৩ জুলাই খারিজ করেন সর্বোচ্চ আদালত। পরে একই বছরের ২৪ ডিসেম্বর সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। কিন্তু অদ্যাবধি সেটি আর শুনানি হয়নি। যদিও গত বছরের ২১ ডিসেম্বর পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) বিষয়ে শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল। ফলে ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের কার্যকারিতা নিয়ে এখনো ধূম্রজাল রয়ে গেছে।
ঢাকার পার্শ্ববর্তী বিপন্ন চার নদী বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা রক্ষায় সীমানা চিহ্নিত করে পিলার স্থাপন, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, নদী খনন ও পলি অপসারণ এবং নদীর তীরে গাছ লাগানোর নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ২০০৯ সালে ওই রায়ের পর এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।
শব্দদূষণ রোধে করা এক রিটের রায় সারা দেশে গাড়িতে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। কিন্তু তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। যানজট ও ধুলাবালির এই ঢাকা শহরে গৃহস্থালির বর্জ্য অপসারণ ও পরিবহণের সময় পথচারীরা দুর্ভোগে পড়ে। তাই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০১৮ নির্দেশনা দেন। কিন্তু ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন তা এখনো বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
ঢাকার চারপাশের নদীর রক্ষণাবেক্ষণ, মহাস্থানগড় সংরক্ষণ, শহীদ মিনারের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ, সরকারি হাসপাতালের রোগীদের কাছ থেকে ভ্যাট ও ইউজার ফি আদায় বন্ধ, পেপার স্প্রে নিষিদ্ধসহ জনগুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। সাভার ও আশুলিয়া এলাকায় কৃষিজমি দখল ও পরিবেশ দূষণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেন আদালত।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশের কবরটি ঠিক রেখে সেখানে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা সব স্থাপনা ভেঙে ফেলতে গণপূর্ত বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী (সিভিল ডিভিশন), ঢাকার জেলা প্রশাসক ও শাহবাগ থানার ওসিকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। গুলশান লেকের পাশে বিটিসিএলের জায়গায় গড়ে ওঠা অবৈধ বস্তিও উচ্ছেদ করতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। খাদ্যে বিষাক্ত ও রাসায়নিকদ্রব্য মেশানো ঠেকাতে মাছ, মিষ্টির দোকানে তদারকিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতেও নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। কিন্তু এসব নির্দেশনার পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।
রাজধানীর ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা থেকে সব ধরনের বাণিজ্যিক স্থাপনা সরাতে সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ, জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণ ফরমালিন ও রাসায়নিকযুক্ত খাদ্যদ্রব্য আমদানি নিষিদ্ধের পাশাপাশি সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীদের কাছ থেকে ইউজার ফি হিসেবে অর্থ আদায় অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। কিন্তু এর বাস্তবায়ন তেমন দেখা যায়নি। বাংলাদেশি বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে সুইস ব্যাংকসহ গোপনে বিদেশে ব্যাংকে পাচারকৃত অর্থ অবিলম্বে ফেরতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে গত ১ ফেব্রুয়ারি রিট করেন আইনজীবী আব্দুল কাইয়ুম খান ও সুবীর নন্দী দাস। সেটির শুনানি নিয়ে রুল জারি করেন আদালত।
জনস্বার্থে মামলার রায় প্রসঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের মামলার ফলে বেশ কিছু রায় ও নির্দেশনা এসেছে। অনেক রায় বাস্তবায়ন হয়েছে, এতে সমাজে অনেক পরিবর্তন এসেছিল। বিষয়টিকে আমি ইতিবাচক হিসেবে দেখি। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের রায় সবারই মানা উচিত। এটা সবার জন্য বাধ্যতামূলক। না মানা আদালত অবমাননার শামিল। আইন মেনে না চললে দেশে আইনের শাসন প্রশ্নবিদ্ধ হবে।