পণ্যের বেঁধে দেওয়া দাম মানে না ব্যবসায়ীরা

জাতীয়

স্বদেশবাণী ডেস্ক : বেসামাল নিত্যপণ্যের বাজার। মজুত ও সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকার পরও চাল, ডাল, ভোজ্যতেল ও পেঁয়াজসহ সব ধরনের পণ্যের দামে আগুন। আয়ের সঙ্গে ব্যয় সামাল দিতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠছে অধিকাংশের।

এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারের পক্ষ থেকে দফায় দফায় পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু তা বরাবরই কাগজে-কলমে আটকে ছিল। ব্যবসায়ীরা তা বাস্তবায়ন করেনি। তারা বেশি দামেই পণ্য বিক্রি করেছে। অথচ ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিরা বৈঠকে সরকারকে আশ্বাস দিয়ে এসেছে। এরপরও তারা কথা রাখেনি।

মাঠ পর্যায়ে সরকার বেঁধে দেওয়া দাম নিশ্চিত করতেও ব্যর্থ হয়েছে সংশ্লিষ্ট সংস্থা। ফলে বাজারে পণ্য কিনতে ভোক্তার বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে।

এদিকে চিনি, পেঁয়াজ ও ভোজ্যতেলের ওপর থেকে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার হচ্ছে এমন খবরেও খুচরা বাজারে কোনো প্রভাব পড়েনি। দোকানে কোনো পণ্যের দাম কমনি। খুচরা ব্যবসায়ী ও ডিলারদের মতে, আমদানি ব্যয় ও প্রচলিত মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় থাকতে হবে। এটা নিশ্চিত করতে না পারলে শুল্ক প্রত্যাহার হলে শুধু লাভবান হবেন মিলমালিক ও উৎপাদনকারীরা।

অভিযোগ রয়েছে, করোনার লোকসান পুষিয়ে নিচ্ছে বড় ব্যবসায়ীরা। ফলে পণ্যের দাম কমছে না। এ ধরনের ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।

জানা গেছে, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কয়েকবার বৈঠক করে ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করে সরকার। প্রতিবারাই ব্যবসায়ীরা সরকারকে আশ্বস্ত করেন দাম বাড়বে না। তারা হাঁকডাক দিয়ে ভোক্তার উদ্দেশে বলেন, সরকারের নির্ধারিত দামেই তেল বিক্রি হবে। কিন্তু বাজারে চিত্র পালটায় না। ব্যবসায়ীরা যতবার বলেছেন দাম বাড়বে না, ঠিক ততবার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ৪-৫ টাকা বেশিতে ভোজ্যতেল বিক্রি করেছে। ফেব্রুয়ারি মাসের পর মার্চ মাসেও দাম নির্ধারণ করে। সে সময়ও চিত্র ছিল একই।

সর্বশেষ ৫ সেপ্টেম্বর বাজার স্থিতিশীল রাখতে ভোজ্যতেলের দাম ঠিক করে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই বৈঠক থেকে ব্যবসায়ীরাও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে দেশের বাজারে পরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য জানানো হয়।

সে অনুযায়ী খোলা এক লিটার সয়াবিন তেলে সর্বোচ্চ খুচরা দাম নির্ধারণ হয় ১২৯ টাকা। বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতিলিটার ১৫৩ টাকা। কিন্তু বাজারে প্রতিলিটার খোলা সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১৩৫-১৪০ টাকা। বোতলজাত সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ টাকা লিটার।

গত নয় সেপ্টেম্বর ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে চিনির দাম নতুন করে নির্ধারণ করে দেয় সরকার। আগস্টের শুরু থেকে দাম বাড়তে থাকায় এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে দাম বেঁধে দেওয়া হয়। এতে সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, দেশবন্ধু গ্রুপসহ কয়েকটি কোম্পানির প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সেদিন খোলাবাজারে প্রতি কেজি চিনি ৭৪ টাকা এবং প্যাকেট ৭৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। অথচ খোলা চিনি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০ এবং প্যাকেট ৮৫ টাকা।

জানতে চাইলে ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, বিভিন্ন সময় সরকারের পক্ষ থেকে পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে কার্যকর হয়নি। যে বা যারা কার্যকর করবে তারা ব্যর্থ হয়েছে। যে কারণে ভোক্তারা সুফল পায়নি। তাই মনিটরিং সংস্থার আদেশ কার্যকর করতে কঠোর হতে হবে।

রমজান মাসেও পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ রাখতে মূল্য নির্ধারণ করে দেয় কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। সে সময় খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ছোলার দাম রাখা হয় ৬৩-৬৭ টাকা, পেঁয়াজ ৪০ টাকা, ভোজ্যতেলের এক লিটারের বোতল ১৩৯ টাকা, পাঁচ লিটারের বোতল ৬৬০ টাকা, মোটা দানার মসুর ডাল ৬৭-৬৯ টাকা এবং চিনির খুচরা মূল্য কেজি প্রতি ৬৭-৬৮ টাকায় ধরা হয়। কিন্তু সে সময়ও সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে পণ্য বিক্রি করেনি বিক্রেতারা।

গত বছর সেপ্টেম্বরে সরকার ৫০ কেজি ওজনের ভালো মানের এক বস্তা মিনিকেট চালের দাম মিল গেটে ২৫৭৫ টাকা এবং মাঝারি মানের চালের দাম ২১৫০ থেকে ২২৫০ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও পরে তা মানা হয়নি। একইভাবে আলুর দাম বেড়ে গেলে পরপর দুবার আলুর দর পুনর্নির্ধারণ করে প্রতি কেজি ৩৫ টাকা বেঁধে দেয় কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। কিন্তু সেই নির্ধারিত দরও মানা হয়নি। তখন প্রতি কেজি আলুর দর ৬০ টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়।

সংশ্লিষ্টরা জানায়, শুধু এবারই নয়, এর আগেও কখনো সরকার নির্ধারিত কোনো ভোগ্যপণ্যের দরই ব্যবসায়ীরা মানেনি। তারা নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশিতে পণ্য বিক্রি করেছে। অথচ সেই পণ্যের দাম নির্ধারণের সময় তারাও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। গত বছর করোনা মহামারি ও চার দফা বন্যার কারণে যখন চালের বাজার অস্থির, তখন মিল মালিকদের পাশাপাশি পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী বৈঠক করে চালের দর নির্ধারণ করে দেন। কিন্তু মিল পর্যায় থেকে দাম মানা হয়নি। যে কারণে বেশি দরে চাল ভোক্তাকে কিনে খেতে হয়েছে।

কাওরান বাজারের নিত্যপণ্য কিনতে আসা মো. মাসুম বলেন, দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার সংশ্লিষ্টরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে রেখে বৈঠক করে। নতুন দাম নির্ধারণ করে। সেখানে দাম বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়। তারপরও ব্যবসায়ীরা নির্ধারিত দামের আরও ৫-১০ টাকা বেশিতে বিক্রি করে। তিনি বলেন, সরকারনির্ধারিত দর ব্যবসায়ীরা না মানলে তা কেন নির্ধারণ করা হয়? যারা নির্ধারিত দর মানছে না তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে না। যারা দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে তারাই কিন্তু সরকারসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করছে। তারা তো চিহ্নিত, তারপরও কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না?

জানতে চাইলে বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার যুগান্তরকে বলেন, যতবার পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ঠিক তখন থেকেই দাম কার্যকর করতে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সারা দেশের বাজার তদারকি করা হয়েছে। এখনো করা হচ্ছে। কিন্তু দাম নিয়ন্ত্রণে আসতে দেরি হয়। কারণ যে খুচরা বিক্রেতা পাইকারি বা মোকাম থেকে বেশি দামে পণ্য কিনে দোকানে মজুত করেছে সেই পণ্য বেশি দরে বিক্রি করেছে। লস দিয়ে বিক্রি করেনি। যে কারণে দাম কমতে একটু দেরি হয়েছে। তবে সরকারের বেঁধে দেওয়া দর কার্যকরে অধিদপ্তরের মনিটরিং সদস্যরা কাজ করেছে। এখনো করছে। এছাড়া অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বিশেষভাবে তদারকি করা হচ্ছে। এবার কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। কঠোর শাস্তির আওতায় এনে বাজার মূল্য পরিস্থিতি ঠিক করা হবে।

বুধবার সরেজমিন দেখা গেছে, বাজারে খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে কেজি ৭৫ থেকে ৮০ টাকায়। প্যাকেট চিনির মূল্য আরও বেশি। আমদানিকৃত পেঁয়াজ ৬৫ টাকা কেজি, মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১৩০ টাকা পর্যন্ত। ৫ লিটারের সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৭শ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে ৪৩ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে চিনির মূল্য বেড়েছে ২৭ শতাংশ।

খুচরা ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি বোতলজাত তেল, প্যাকেট চিনি ও খোলা চিনির লাভ কমিয়ে দিয়েছে। কাওরান বাজারের এক খুচরা বিক্রেতা অভিযোগ করে বলেন, কোম্পানির লোকজনকে বলেছি আপনারা গায়ের মূল্য বৃদ্ধি করেছেন কিন্তু আমাদের লাভ বৃদ্ধি করেননি। জবাবে কোম্পানির লোকজন বলেছে, সরকার ভ্যাট ও কর বাড়িয়েছে। এজন্য দাম বাড়ানো হয়েছে। অনেকে সানফ্লাওয়ার ভোজ্যতেল খেত। দাম বৃদ্ধির কারণে সেটি বাদ দিয়ে সয়াবিন খাচ্ছে।

ডিলাররা জানান, শুল্ক প্রত্যাহার করলে এর সুফল পাবে উৎপাদনকারী। তারা মিলগেটে দাম না কমালে শুল্ক প্রত্যাহার করে লাভ হবে না। তারা আরও বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়তে থাকলেও শুল্ক কমিয়ে লাভ হবে না।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *