‘ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে ঘর বাঁধলে হয়তো জীবনটা সুখের হবে, কিন্তু…’

জাতীয়

স্বদেশবাণী ডেস্ক:  লাবণ্যের গর্ভে সন্তান আসার পর শ্বশুরবাড়িতে মাছ, মাংস, ডিম খাওয়া নিষেধ ছিল তার। ভাতের সঙ্গে আলু ভর্তা আর ডাল ছিল নিয়মিত খাবার। চিকিৎসকের কাছে নিতেও নিষেধ ছিল স্বামী শাহীন আলমের। ডাক্তারের কাছে যেতে হলে বাবার বাড়িতে ফিরে যেতে হবে।

ওর বাবা কথা দিয়েছিল, সাত-আট দিন পর মেয়েকে তার কাছে নিয়ে যাবে। সেই সময়ও তারা দিতে রাজি হয়নি। গর্ভবতী সুরাইয়াকে প্রচণ্ড মারধর করত। মেয়েটি নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে একপর্যায়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। এ খবর পেয়ে সুরাইয়ার বাবা আরিফুল ইসলাম মেয়ের শ্বশুরবাড়ি গিয়ে তাকে নিয়ে আসেন।

এরপর গত ১ আগস্ট থেকে সে দাদির কাছেই ছিল। স্বামী-শাশুড়ির অত্যাচার-নির্যাতন সইতে না পেরে নিজেই নিজের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। শরীরের ৯০ ভাগ পোড়া নিয়ে হাসপাতালে শুয়েই মৃত এক কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছে সে। এর কয়েক ঘণ্টা পরই পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় হতভাগী সুরাইয়া।

এসব কথা কেঁদে কেঁদে বলছিলেন সুরাইয়াকে লালন পালন করা তার নানি জাহেরা খাতুন (৭০)। জাহেরা খাতুনের বাড়ি দুর্গাপুর উপজেলার নলজোড়া গ্রামে।

জানা যায়, ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে লাইফ সাপোর্টে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে সুরাইয়া নেওয়াজ লাবণ্যর মৃত্যু হয়। এর আগে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) সুরাইয়া নেওয়াজের বাবা আরিফুল ইসলাম ও মা আফরোজা ফাতেমা হ্যাপী মেয়ে সুরাইয়ার জন্ম দেয়া কন্যাসন্তানকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করেন। আর সুরাইয়া মারা যাওয়ার পর নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার গাখাজোড়া গ্রামে শুক্রবার রাত ১১টায় পারিবারিক কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়।

লাবণ্যর বাবা আরিফুল ইসলাম বলেন, দেখে মনে হচ্ছিল- লাবণ্যর বাচ্চাটাও খুব কষ্ট পেয়েছে। গত ৯ অক্টোবর কেরোসিন ঢেলে নিজের শরীরে আগুন দেয় মেয়েটি। এরপর থেকে বৃহস্পতিবার ভোর পর্যন্ত থেমে থেমে কথা বলেছে সুরাইয়া। মৃত সন্তান জন্ম দেওয়ার পর লাইফ সাপোর্টে চিকিৎসাধীন ছিল সে। এরপর আর কথা বলেনি আমার মেয়ে।

তিনি আরও বলেন, মেয়েটি বাবার জন্য পাগল ছিল। আমাকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝত না। লাবণ্যই চায়নি তার স্বামীকে বাবা টাকা-পয়সা দিক। একমাত্র মেয়ে ছিল সে। শিক্ষক আরিফুল পারিবারিকভাবে যথেষ্ট সচ্ছল।

লাবণ্যর মামা জাহাঙ্গীর মাহমুদ  বলেন, ৯ অক্টোবর সন্ধ্যা ৭টার দিকে স্বামী শাহীন আলমের সঙ্গে সুরাইয়ার কথা হয়। এরপরই গায়ে আগুন দেয় লাবণ্য। নেত্রকোনার কলমাকান্দা থেকে মুমূর্ষু লাবণ্যকে প্রথমে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। একদিন পর সেখান থেকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনার বিষয়ে শ্বশুরবাড়িতে সংবাদ দেওয়া হয়েছিল কিন্তু তারা কেউ কোনো খোঁজও নেয়নি।

লাবণ্যর শ্বশুরবাড়ি ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলায়। লাবণ্যকে সেখান থেকে এনে কলমাকান্দার গাখাজোড়া গ্রামে দাদির কাছে রেখে এসেছিলেন তার বাবা আরিফুল ইসলাম হারুন। পাঁচ দিন আগে ওই বাড়িতে থাকা অবস্থায় ফোনে স্বামীর সঙ্গে কথা বলে রাগারাগি হওয়ার পর গায়ে আগুন দেয় সুরাইয়া।

লাবণ্যর মা আফরোজা ফাতেমা বলেন, আমাদের সংসারে বিবাহ বিচ্ছেদের পর নানি এবং দাদির কাছে বড় হয় লাবণ্য। সে ভেবেছিল, ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে ঘর বাঁধলে জীবনটা সুখের হবে। কিন্তু মাস দুয়েক পর থেকেই শ্বশুরবাড়িতে শুরু হয় তার ওপর নির্যাতন। যৌতুকের জন্য স্বামী, শাশুড়ি নানাভাবে অত্যাচার শুরু করে। ১৬ মাসের সংসারে দফায় দফায় সালিশ বৈঠক হয়েছে। কিন্তু মীমাংসা হয়নি, আমার মেয়ে জীবন দিয়ে এ নির্যাতনের মীমাংসা করে দিল।

তিনি বলেন, লাবণ্যর বাবার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের পর আমি ঢাকায় সেলাইয়ের কাজ করে কোনোরকমে টিকেছিলাম। তবু মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে আসার চেষ্টা করছিলাম। মেয়ে আমার সেটুকু সময় দেয়নি। মেয়েকে আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়ার তার স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির লোকজনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।

সুরাইয়া নেওয়াজ লাবণ্যর বিষয়ে জানতে তার স্বামী শাহীন আলমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের পাওয়া যায়নি। শাহীনের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়া উপজেলার দক্ষিণ মাইজপাড়া ইউনিয়নের খাগগড়া গ্রামে। সে ওই গ্রামের আবু তাহেরের ছেলে।

লাবণ্যের চাচা সাইদুল ইসলাম সাঈদ বলেন, আমার ভাতিজিকে প্রথমে ফুসলিয়ে বিয়ে করে যৌতুকের জন্য মারধর করত। এসব নিয়ে অনেকবার বিচার বৈঠক হয়েছে। মেয়েটিকে বাড়িতে নিয়ে আসার পরও মোবাইল ফোনে হুমকি দিয়ে গালমন্দ করত। ঘটনার আগেও তার স্বামী ফোনে যৌতুক চেয়ে হুমকি দিয়েছে। এ ঘটনায় সর্বোচ্চ বিচার চাই। আসামিদের ফাঁসি চাই। এ বিচারের দৃষ্টান্ত দেখে আর কেউ যেন এমন করতে সাহস না পায়।

এ ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে নেত্রকোনার কলমাকান্দা থানার ওসি আবদুল আহাদ যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয়ে শনিবার সকালে থানায় মামলা হয়েছে। লাবণ্যর চাচা কলমাকান্দা উপজেলার গাখাজোড়া গ্রামের সাইদুল ইসলাম সাঈদ বাদী হয়ে স্বামী শাহীন আলম, ভাসুর শাহান মিয়া, শাশুড়ি মমতা আক্তার, ননদ শারমিন আক্তার, শ্বশুর আবু তাহের ও শাহীনের বন্ধু আশরাফুল ইসলামকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেছেন। আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *