পর্যাপ্ত পাথরের অভাবে মরণফাঁদ রেলপথ!

জাতীয়

স্বদেশবাণী ডেস্ক : রেললাইনে প্রয়োজনীয় পাথর না থাকায় রেলপথ যেন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। কোথাও আবার পাথরের ছিটেফোঁটাও নেই, কোথাও শুধু মাটির ওপরে পড়ে আছে রেললাইন। পাথরবিহীন রেললাইনে উনিশ থেকে বিশ হলেই ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনা হচ্ছে। এতে প্রাণহানিসহ লোকসান গুনতে হচ্ছে। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষের কোনো মাথাব্যথা নেই বলে অভিযোগ।

জানা গেছে, পুরো রেলপথে প্রায় দেড় কোটি ঘনফুট (সিএফটি) পাথরের প্রয়োজন হলেও রয়েছে মাত্র পাঁচ শতাংশ (সাড়ে সাত লাখ ঘনফুট)। যৎসামান্য পাথর দেওয়া হলেও টেন্ডার থেকে শুরু করে পাথর ফেলা এবং সেকশন নির্বাচন নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও কাঁড়ি কাঁড়ি। রেলবহরে ১২০ কিলোমিটার গতিসম্পন্ন বেশ কয়েকটি অত্যাধুনিক ট্রেন রয়েছে। পাথরবিহীন ঝুঁকিপূর্ণ লাইন হওয়ায় এসব ট্রেন গড়ে মাত্র ৬৭ কিলোমিটার গতি নিয়ে চলছে। সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য, পাথর সংকট দিন দিন চরমে উঠছে। নতুন নতুন প্রকল্পের কারণে বিষয়টি চাপা পড়ে যাচ্ছে।

রেলপথমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন যুগান্তরকে বলেন, নতুন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সঙ্গে রেলপথকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। যাত্রীসেবা বাড়াতে অত্যাধুনিক ট্রেন চালানো হচ্ছে। তিনি বলেন, তবে নির্ধারিত গতিতে ট্রেন চালানো সম্ভব হচ্ছে না। কারণ রেলপথের সমস্যা পুরোনো। রেলপথ সংস্কার ও পাথর দেওয়ার বিষয়ে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় শতভাগ পাথর আমদানি করতে হচ্ছে। লাইনে পাথর ফেলা শুরু হয়েছে। আগামীতে বরাদ্দ আরও বাড়ানো হবে। এছাড়া পাথর দেওয়া নিয়ে টেন্ডার, লাইনে পাথর ফেলা এবং সংশ্লিষ্টদের কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত পেলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

রেলপথ মন্ত্রণালয় ও রেলওয়ে বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রেলে বর্তমানে প্রায় চার হাজার ৪০৩ কিলোমিটার রেল ট্র্যাক রয়েছে। এসব ট্র্যাকে প্রায় তিন যুগ ধরে পাথর স্বল্পতা রয়েছে। পুরো রেলের কোথাও রেলওয়ের নিয়ম-নির্দেশনা অনুযায়ী পাথর নেই। হিসাব বলছে, লাইনের ধরন অনুযায়ী স্লিপারের নিচে ৬ থেকে ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত পাথর থাকতে হয়। একই সঙ্গে লাইনের দুই পাশে ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত পাথর থাকতে হয়। স্লিপারের মধ্যস্থলে পাথর সমান রাখতে হয়। বর্তমানে রেললাইনের কোথাও নিয়ম অনুযায়ী পাথর নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্লিপারের নিচে মাটি দেখা যায়। কোথাও কোথাও আগাছাও দেখা যায়।

রেলওয়ে পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চল প্রকৌশলী দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রেললাইনে পাথরের সংকট প্রায় তিন যুগ আগে থেকে শুরু হয়েছে। একটি লাইনে প্রতিবছর মোট পাথরের ৫ থেকে ১০ শতাংশ ফেলতে হয়। সেই হিসাবে বছরে প্রায় দেড় কোটি ঘনফুট (সিএফটি) পাথর প্রয়োজন। কিন্তু ২০২০-২১ অর্থবছরে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের লাইনে ২৯ হাজার ঘনফুট এবং পূর্বাঞ্চলে ১৫ হাজার ঘনফুট পাথর ফেলা হয়। এদিকে লাইনে পাথর দেওয়া নিয়ে টেন্ডার থেকে শুরু করে পাথর ফেলা পর্যন্ত নানা অনিয়ম-দুর্নীতি হয়ে থাকে। রেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। এ নিয়ে বেশ কয়েকজন রেলওয়ে কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্তও করছে। মাঠ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, দিনের পর দিন পাথরবিহীন লাইনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হলেও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে না। যাদের দায়িত্ব তারা এক থেকে দুবার ট্রলি দিয়ে রেলপথ পরিদর্শন করে তাদের দায়িত্ব শেষ করেন।

জানা গেছে, গত অর্থবছরে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল রেলের জন্য প্রায় ৪৫ কোটি টাকার পাথর কেনা হয়। লাইনে এসব পাথর ফেলা নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। যথাযথভাবে পাথর না ফেলেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কতিপয় রেলওয়ে কর্মকর্তার সঙ্গে অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে বিল নিয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের কয়েকজন প্রকৌশলী জানান, ‘রেলওয়ের শীর্ষ ব্যক্তিদের ছেলে-ভাগ্নে থেকে শুরু করে দলীয় নেতারা পর্যন্ত পাথরের টেন্ডার ও মালামাল ক্রয়ের বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাদের ইশারায় নির্ধারিত হচ্ছে কে টেন্ডার পাবে।’

পূর্বাঞ্চল রেলের প্রধান প্রকৌশলী মো. সুবক্তগীন যুগান্তরকে বলেন, গত অর্থবছরে পূর্বাঞ্চল রেললাইনে ৮ লাখ ঘনফুট পাথর ফেলা হয়েছে। এ যেন মহাসাগরে এক ফোঁটা পানি ফেলানোর মতো ঘটনা। চাহিদার তুলনায় এটি মাত্র ৫ থেকে ৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ২০ লাখ ঘনফুট পাথর ফেলা। এটাও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। গত অর্থবছরে প্রায় ৩৫ কোটি টাকার পাথর ফেলা হয়েছে। এবার লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৭৫ কোটি টাকা। লাইনে নির্ধারিত পাথর দিতে হলে কোটি কোটি টাকার প্রয়োজন। পর্যায়ক্রমে পাথর ফেললেও আগামী ১০ বছর সময় লাগবে। কারণ পাথর স্বল্পতা দীর্ঘদিনের। বর্তমান সরকার রেলে বরাদ্দ বাড়াচ্ছে-বরাদ্দ পেলে ধীরে ধীরে নির্ধারিত পাথর ফেলা সম্ভব হবে।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (রেলপথ) মো. আসাদুল হক যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে রেলবহরে যুক্ত হওয়া অত্যাধুনিক ট্রেনগুলোর গতি উঠানো সম্ভব হচ্ছে না কেবল পাথরবিহীন রেলপথলাইনের জন্য। গত বছরে মাত্র ২৯ হাজার ঘনমিটার পাথর দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সেকশন ঘুরে দেখেছি-পাথরস্বল্পতা ভয়ানক রূপ নিয়েছে। আমরা সেকশন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের কাছ থেকে পাথরের চাহিদা নিচ্ছি। যে চাহিদা পাচ্ছি, বরাদ্দ অনুযায়ী তা পূরণ করতে হলে যুগ পেরিয়ে যাবে। চলতি অর্থবছরে আমরা ৫০ হাজার ঘনমিটার পাথর ফেলার পরিকল্পনা নিয়েছি। গত বছর প্রায় ২৩ কোটি টাকার পাথর কেনা হয়েছে। এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।

রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, রেলপথে পাথর স্বল্পতা বহু বছরের। প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম পাথর দেওয়া হচ্ছে-এটা নিশ্চিত। তবে বরাদ্দ পেলে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পাথর লাইনে ফেলা হবে। লাইন যথাযথ রাখার অন্যতম মাধ্যম হলো লাইনে পর্যাপ্ত পাথর থাকা। সেটা নিশ্চিত করতেই হবে।

রেলওয়ের হিসাব অনুযায়ী-পাথরবিহীন রেলপথের কারণে ট্রেনের প্রায় ৯০ শতাংশ লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটে। নিরাপদ রেলপথ নিশ্চিত করতে যথাযথ পাথর থাকা দরকার। ভারত, মালয়েশিয়া ও শ্রীলংকাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পাথর আমদানি করা হয়। ২-৩ গুণ বেশি দামে পাথর আমদানি করতে হচ্ছে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *