জামিন নেই, তবুও অধরা ২ হাজার আসামি

জাতীয়

স্বদেশবাণী ডেস্ক :  রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ‘হেফাজত তাণ্ডব’র ঘটনায় চলতি বছর ১৬৫টি মামলা হয়। এসব মামলায় আসামি করা হয় হেফাজতে ইসলামের চার হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে। তাদের মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে দুই হাজারের বেশি। এদের মধ্যে জামিন নিয়েছেন প্রায় এক হাজার ৩০০ আসামি। এই মুহূর্তে কারাগারে আছেন প্রায় ৭০০ জন। বাকি দুই হাজার আসামি জামিন নেননি। তবুও তারা অধরা।

এছাড়া ২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে ভয়াবহ তাণ্ডবের ঘটনায় মোট ৮৩টি মামলা হয় হেফাজত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এরপর ২০১৫ থেকে ২০২০ সালে বিভিন্ন ইস্যুতে কয়েক দফায় দেশের বিভিন্ন স্থানে নাশকতার ঘটনায় আরও ২০টি মামলা হয়। সব মিলিয়ে হেফাজত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১০৩টি পুরোনো মামলা (চলতি বছর ছাড়া) আছে।

পুরোনো মামলাগুলোর মধ্যে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হচ্ছে ২৯টির। আর ৪টি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। বাকি ৭০টি মামলার তদন্ত চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকলেও ‘ধীরে চলো নীতি’ অনুসরণ করছে সংশ্লিষ্টরা।

তবে গত মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের বিরোধিতা করে দেওয়া কর্মসূচিতে তাণ্ডবের পর যেসব মামলা হয়েছে সেগুলোর তদন্ত শেষ পর্যায়ে। শিগগিরই বেশির ভাগ মামলাতেই অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

এদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সংশ্লিষ্ট সূত্র যুগান্তরকে জানিয়েছে, ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন থানায় হেফাজতে ইসলাম এবং বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে ৭১টি মামলা রয়েছে। এসবের মধ্যে ২০১৩ সালে ৫৩টি, ২০২০ সালে ৩টি এবং চলতি বছর ১৫টি মামলা হয়। এসব মামলার মধ্যে এ পর্যন্ত চারটিতে (২০১৩ সালের) অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। একটি মামলায় স্থগিতাদেশ দিয়েছেন আদালত। বাকি ৬৬টি মামলাই তদন্তাধীন।

ডিএমপি সূত্র জানায়, ঢাকায় গ্রেফতার হওয়া ২৮৫ নেতাকর্মীর ২৩৪ জন এরই মধ্যে জামিন পেয়ে গেছেন। ডিএমপিতে হেফাজত ইস্যুতে দায়ের করা মামলাগুলোর মধ্যে অন্তত সাতটি মামলায় বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এসবের মধ্যে পল্টন থানার তিনটি, শাহবাগ থানার দুটি এবং যাত্রাবাড়ী থানার দুটি মামলা রয়েছে।

এসব মামলায় হেফাজত নেতাকর্মীদের বাইরের উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন-ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, যুবদলের সভাপতি সাইফুল ইসলাম নিরব, সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, স্বেচ্ছাসেবক দল সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের ভূইয়া জুয়েল প্রমুখ। তারা সবাই জামিনে আছেন।

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) কামরুজ্জামান যুগান্তরকে জানান, আমার কাছে পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায় এ বিষয়ে মন্তব্য করতে পারছি না। হেফাজতের বেশির ভাগ মামলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এবং ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন তদন্ত করছে। তারা এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, চলতি বছর যেসব মামলা হয়েছে সেগুলো তদন্ত শেষ পর্যায়ে। এখন কেবল আসামিদের নাম-ঠিকানা যাচাই করা হচ্ছে। চলতি বছর যেসব মামলা হয়েছে সেগুলোর অভিযোগপত্র দেওয়ার জন্য প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হচ্ছে। এ বছরের মধ্যেই আদালতে কিছু মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেসব আসামি আদালত থেকে জামিন নেননি তাদের ধরতে ইতোমধ্যে আমরা অভিযান শুরু করেছি। মাঝে মধ্যেই তারা ধরা পড়ছে। শিগগিরই এ ব্যাপারে বড় অভিযান চালানোর সম্ভাবনা আছে।

সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান বলেন, হেফাজতে আমরা বেশি কিছু মামলার তদন্ত আমরা করছি। আগের যেসব মামলা হয়েছে সেসব মামলার তদন্ত একটি পর্যায়ে এসেছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী সেসব বিষয়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চলতি বছর দায়ের হওয়া যেসব মামলা সিআইডির হাতে এসেছে সেগুলোর তদন্ত শেষের দিকে। শিগগিরই অভিযোগপত্র দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ চলছে।

হেফাজতে ইসলামের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর গ্রেফতার হওয়া নেতাদের মধ্যে এখনো যারা কারাগারে আছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-মাওলানা মামুনুল হক, জাকারিয়া নোমান ফয়েজী, জুনাইদ আল হাবিব, আজিজুল হক ইসলামাবাদী, মুফতি শাখাওয়াত হোসাইন রাজি, মাওলানা জালাল উদ্দীন, মুফতি শরীফ উল্লাহ, মুফতি ফখরুল ইসলাম, কোরবান আলী কাসেমী, খুরশিদ আলম কাসেমী, মুফতি ডা. আহমেদ আব্দুল কাদের প্রমুখ।

হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মীর ইদ্রিস যুগান্তরকে বলেন, আমাদের যেসব নেতাকর্মীকে এখনো কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে তাদের জামিনের জন্য আইনগত চেষ্টা করছি। কিন্তু আদালত স্বাধীন না হওয়ার কারণে সমস্যা হচ্ছে। আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছে সেগুলো সবই রাজনৈতিক। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া এসব মামলা প্রত্যাহার হবে না। তাই বিষয়টি নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছি। পুরাতন মামলাগুলো প্রত্যাহারের পাশাপাশি নতুন মামলাগুলোতে যেন অভিযোগপত্র দেওয়া না হয় সে বিষয়ে কথা হচ্ছে। তবে এখনো বলার মতো কোনো অগ্রগতি হয়নি।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের যেসব নেতাকর্মী এখনো জামিন নেননি তাদের জামিনের চেষ্টা চলছে।

উল্লেখ্য, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতির বিরোধিতার মধ্য দিয়ে ২০১০ সালে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন প্রয়াত শাহ আহমদ শফী। ২০১১ সালে সংগঠনটি বাংলাদেশ নারী উন্নয়ন নীতির কয়েকটি ধারাকে ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক দাবি করে এর তীব্র বিরোধিতা করে।

এরপর বাংলা নববর্ষ এবং পহেলা বৈশাখকে বিদেশি সংস্কৃতি হিসেবে প্রচার করে বিরোধিতা করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নিয়েও বিতর্কিত মন্তব্য করেন হেফাজত নেতারা। সংগঠনটির বিরোধিতার মুখে ঢাকায় সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে গ্রিক দেবীর আদলে নির্মিত একটি ভাস্কর্য সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।

২০১৩ সালে রাজধানীর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে কথিত নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবি জানায় তারা। ওই বছরের ৫ মে ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে অবরোধ কর্মসূচি শেষে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেন হেফাজতের বিপুলসংখ্যক কর্মী-সমর্থক। একপর্যায়ে হেফাজতের উগ্র নেতাকর্মীরা সরকারি-বেসরকারি কার্যালয়ে আগুন, ভাঙচুর ও নাশকতা চালায়।

গত ২৬ মে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে ঘিরে বিরোধিতা করে হেফাজতে ইসলাম বিক্ষোভ সমাবেশ ডাকে। মোদিবিরোধী এ সমাবেশ থেকে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। সেই সংঘাতের সূত্র ধরে সারা দেশে ব্যাপক সংঘাত-সংঘর্ষ হয়। সরকারি সম্পদ ও জনসাধারণের সম্পদে আগুন, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। গুলিতে প্রাণ যায় ১৭ জনের।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *