যাচ্ছিলাম অ্যাডামস পিক-আদম পাহাড়ের পথে

জাতীয়

স্বদেশ বাণী ডেস্ক: যাচ্ছিলাম অ্যাডামস পিক, আদম পাহাড়। এটি শ্রীলঙ্কার মাঝামাঝি একটি জায়গা। চারদিকে পাহাড় ঘেরা, পর্বতশ্রেণি বলা চলে। ওই দুর্গম জায়গার একটি পাহাড় চূড়ায় আদম বা অ্যাডামস পৃথিবীতে প্রথম পদার্পণ করেন। সেখানে নাকি আদমের পায়ের ছাপ রয়েছে। অ্যাডামস বা আদমের সেই পায়ের ছাপ দেখার জন্য আমাদের যাত্রা। কতদিন ধরে শুনছিলাম- অ্যাডামস পিক! অবশেষে সেই সৌভাগ্য এসেছিল।

রাজধানী কলম্বো থেকে অ্যাডামস পিক এর দূরত্ব প্রায় ১৫০ কিলোমিটার। সকাল বেলা আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া আরেক অতিথি- সাংবাদিক ইমরুল কাউসার ইমন। যাতায়াতের সুবিধার জন্য একটা কার ভাড়া করেছিলাম। ইমন স্বাস্থ্যবান মোটাসোটা- তাই তাকে দেয়া হলো ড্রাইভারের পাশে, সামনের সিট। পেছনের সিটে আমার সঙ্গে ফিরোজ আর মিলটন।

যেখানে যাচ্ছিলাম এলাকাটির নাম ডেলহাউজ বা ডালহাউজ। কেউ কেউ বলেন, ডালহৌসী। ভারত বর্ষে ইংরেজ গভর্নর ছিলেন লর্ড ডালহৌসী। তার নামেই ওর নামকরণ কি না, কে জানে। ঠিক যেখান থেকে পাহাড়ে উঠতে হয় তার নাম নাল্লাথান্নিয়া। সেখানে একটি নালা আছে, ঝর্ণা বা খালের মতো। যদিও স্থানীয়রা ওটাকে রিভার বলে। ওই নদী পার হয়েই আদম পাহাড়ে উঠতে হয়। আমাদের হোটেল বুকিং ছিল ওই নাল্লাথান্নিয়াতে। নদীর পাড়েই। আদম পাহাড়ে উঠতে হয় যেখান থেকে, ঠিক সেই পয়েন্টেই হোটেলটির অবস্থান।

কলম্বোতেও প্রায় ঢাকার মতো জ্যাম; প্রায় মানে ঢাকার অর্ধেক। খুব সকালে রওনা হয়েছিলাম বলে রাস্তা ছিল ফাঁকা। অল্প সময়েই মধ্যেই শহর থেকে বেরিয়ে গেলাম। এয়ারপোর্ট থেকে ক্যান্ডি বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যাওয়ার হাইওয়ে তৈরি করেছে সরকার। যাচ্ছিলাম সেটা ধরেই। শহর থেকে বের হওয়ার শেষ মাথায় একটি নদী। নাম কেলানী। এয়ারপোর্ট থেকে কলম্বো শহরে যেতেও ওই নদী পার হতে হয়। দেশের চতুর্থ বৃহত্তম নদী এটা। এই নদী বয়ে গেছে অ্যাডামস পিক সংলগ্ন পাহাড়ি অঞ্চল দিয়ে। সেখানে এর এক শাখা নদীতে বাঁধ দিয়ে কৃত্রিম বেসিন তৈরি করা হয়েছে। যেখানে একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। জায়গাটা অসাধারণ সুন্দর। লাল মাটি, নীল জল আর সবুজ গাছপালা- সব মিলিয়ে এক অসাধরণ রঙিন ক্যানভাস। এমন সৌন্দর্য মাটির পৃথিবীতে খুব বিরল!

২০১৩ সালের দিকে কয়েকবার ক্যান্ডি গিয়েছিলাম ওই পথ ধরে। তখন রাস্তার সংষ্কার কাজ চলছিল। এর মাঝে ২০১৭ সালে আরেকবার শ্রীলঙ্কা গেলেও ওপথ মাড়ানো হয়নি। ২০১৯ সালে সিলন (শ্রীলঙ্কার পুরনো নাম) ভ্রমণে আবার সেই পথে। পুরো দেশটাজুড়ে অসংখ্য গাছপালা। এত বৃক্ষ লতাপাতা আর কোনো দেশে দেখিনি।

বেলা তখন ১১টা। রাস্তার ধারে একটা দোকানের গাড়ি থামল। শ্রীলঙ্কায় হলদে রঙের ডাবকে বলা হয় কিং কোকোনাট। এটার পানি অনেক স্বাদু। ডাবের পানির পর খেলাম বিস্কুট আর চাপা কলার মতো খুব মজার পাহাড়ি কলা। শেষ করে আবার প্রাইভেটকারে।

আধা ঘণ্টা যাবার পর গাড়ি নেমে গেল ডানদিকে অপেক্ষাকৃত সরু রাস্তায়। দু-পাশে জঙ্গল। মানুষজন খুব একটা ছিল না। ড্রাইভার কিছুটা ইতস্তত করছিলেন। কলম্বো থাকেন তিনি। রাজধানীর বাইরের রাস্তাঘাট খুব একটা চেনেন না মনে হলো। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখলাম একটা অটোতে কিছু শিক্ষার্থী। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল। চালককে স্থানীয় ভাষায় জিজ্ঞেস করা হলো অ্যাডামস পিক এ যাওয়ার রাস্তা ঠিক আছে কি না। না, ঠিক নেই। অন্য রাস্তায় যান। আমাদের চালক গাড়ি ঘুরিয়ে ব্যাক করল ওই রাস্তা ধরে। তারপর ধরলেন দক্ষিণের আরেকটা রাস্তা।

গাড়ি যাচ্ছিল পূর্ব-দক্ষিণ কোণে। যতই ভেতরে যাচ্ছিলাম ততই জঙ্গল আরো গভীর হচ্ছিল। ধীরে ধীরে টিলা থেকে পাহাড়ে প্রবেশ করছিলাম। দুপাশে ঘন অরণ্য। আবার কখনো এক পাশে পাহাড়, আরেক পাশে খাঁদ। ধীরে ধীরে জনমানবের চিহ্ন কমে আসছিল। রাস্তায় ছিল বিপজ্জনক বাঁক। রাস্তার পাশ দিয়ে নেমে যাচ্ছিল ঝর্ণা। জলের কূলকূল ধ্বনি, পাখির ডাক, ঘণ অরণ্য- সব মিলিয়ে দারুণ অ্যাডভেঞ্চার।

পাহাড়ি দুর্গম পথে যাচ্ছিলাম কেবল। পথ ফুরোচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল আফ্রিকার গহীন অরণ্যে প্রবেশ করছিলাম। সেখান থেকে যেন বোরোনোর পথ নেই। আকাশ ছোঁয়া পাহাড়। মনে পড়ছিল নজরুলের গান- আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই..।

এক পর্যায়ে চোখে পড়ল কিছু চা বাগান। রাস্তাগুলো সাজানো গোছানো। পাহাড়ের উচ্চতা কিছুটা কমে গেল। পথের দু-পাশে একটার পর একটা চা বাগান। আরো সামনে গিয়ে দেখলাম অনিন্দ সুন্দর লেক। লেকের জল অতি মাত্রায় নীল। দুপুরের উজ্জ্বল ঝাঁঝালো রোদে কাক চক্ষুর মতো জল। লেকের পাড়ে লাল মাটি। রিভার্স ক্যানভাস নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে সারি সারি হ্যান্ডসাম সৌন্দর্য বৃক্ষ। এটি সেই কেলানীর শাখা নদীর বেসিন। রাঙামাটির কাপ্তাই লেকের মতো অনেকটা। তবে জলের স্তর অনেক নিচে। আমরা যাচ্ছিলাম অনেক উঁচু রাস্তা দিয়ে।

এটাকে বলা হয় মাস্কেলিয়া বাঁধ। জলের ধারা আটকে রেখে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র করা হয়েছে। ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি হয় এখানে। এর আগে ক্যান্ডি থেকে দক্ষিণ পূর্বদিকে বিশাল এক জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে গিয়েছিলাম। জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উজানের পানি অসম্ভব সুন্দর দেখায়। জলাধার টইটুম্বুর ভরা, মনে হয় যৌবনা ষোড়শী নারী। মাস্কেলিয়ায় কোনো রিসোর্ট নেই মনে হলো। তবে এখানে কিছু জলপ্রপাত আছে। পযর্টনের জন্য এটি চমৎকার স্পট। জায়গা এত সুন্দর- যে কেউ চাইবেন সেখানে অন্তত একটা দিন কাটাতে।

মাস্কেলিয়া ওয়াটার ড্যাম এরিয়ায় ঢুকে যাচ্ছিলাম সোজা দক্ষিণে। অনেকক্ষণ লাগল লেক এরিয়া পার হতে। লেকের শেষে পথ বাঁকা, সোজা পশ্চিমে। পাহাড়ের ভাঁজ কেটে কেটে রাস্তা বানানো। যতই সামনে যাচ্ছিলাম ততই উঁচু পাহাড় দেখছিলাম। অ্যাডামস পিকের প্রায় ৫০ কিলোমিটার আগে থেকে শুরু হয়েছে পাবর্ত্য এলাকা। মূল পাহাড়ের চারদিকে অসংখ্য উঁচু পাহাড়। সেগুলোও অ্যাডামস পিকের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

একটা জায়গায় দেখা গেল রাস্তার পাশে অসংখ্য বানর। লাল মুখো বানর। এটা নাকি শ্রীলঙ্কার কেবল এই জায়গাটাতেই দেখা যায়। বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি। ছোট বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে খাবারের আশায় রাস্তার পাশে অপেক্ষা করছিল। খিদে পেয়েছিল আমাদেরও। কিন্তু উপায় নেই। কোথাও লোকালয় নেই। বাজার নেই, স্টেশন নেই, দোকান নেই, হোটেল নেই। কিন্তু আছে অপার সৌন্দর্য।

বুঝতেছিলাম অ্যাডামস পিক এর কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলাম। হঠাৎ কানে এসেছিল কড়া জলের শব্দ। দেখলাম কিছুটা ঢালু রাস্তা, পিচ ঢালা কিন্তু তাতে জল। ডান পাশে অনেক উঁচু থেকে খাড়াভাবে পড়ছিল ঝর্ণা। একটা পাকা কালভার্টের নিচ দিয়ে জল চলে যাচ্ছিল। জঙ্গলের নিচ দিয়ে পাহাড়ি পাথর ভিজিয়ে মিশে গিয়েছিল গহীন অরণ্যে। কোন অজানায় চলে গিয়েছে কে জানে।

ড্রাইভার বলছিলেন, অ্যাডামস পিক বেস লাইনের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলাম আমরা। কয়েকটা হোটেল দেখলাম রাস্তার দক্ষিণ পাশে। থ্রিস্টার বা টুস্টার মানের হবে। হোটেলের উত্তর পাশটা ছিল উঁচু পাহাড়ে ঘেরা। রাস্তাটা পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা। সূর্য ততক্ষণে মেঘের আড়ালে। রাস্তায় মেরামত কাজ চলছিল।

চারদিকে পাহাড়ঘেরা একটা জায়গায় গিয়ে গাড়ি থামল। চারদিকটা কোলাহলমুক্ত নীরব। একটা রেস্টুরেন্ট ছিল। ছিল দু-একটা দোকান। লোকজন খুবই কম। আমরা গিয়েছিলাম আগস্ট মাসে। ওই সময় সেখানে মানুষজন খুব একটা যান না। পর্যটকের সংখ্যা খুবই কম। এলাকার দোকান পাট বেশিরভাগই বন্ধ। মৌসুমী দোকান সবই বন্ধ।

বুকিং ছিল মাউন্টেইন ভিলেজ নামে একটি হোটেলে। সেটি কোথায়? রাস্তা মনে হচ্ছিলো শেষ। তাহলে কোন দিকে যাব? হেঁটে যেতে হবে? একজনকে জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, গাড়ি যাবে হোটেলে। পশ্চিম পাশ দিয়ে নিচে নেমে যান।

আমরা হাঁছিলাম। গাড়ি আমাদের পেছন পেছন চলছিল। পশ্চিমে নেমে গিয়ে দক্ষিণে বাঁক নিয়েছে রাস্তা। আবার সেখান থেকে পূবদিকে বাঁক। ঠিক ওই বাঁকে একটা মন্দির। তাতে বিশাল এক বৌদ্ধমূর্তি। কিন্তু মূর্তির শরীরে অনেকগুলো মৌমাছি চাঁক বেঁধেছে। চাঁক আপাতত থাক। আগে হোটেলে যাওয়ার তাড়া।

সামান্য একটু এগোলেই দক্ষিণে আবার মোড় নিয়েছে রাস্তা। হাতের বায়ে হোটেল মাউন্টেইন ভিলেজ। ডানে অ্যাডাসম পিকে উঠার রাস্তা।

দু-তলা হোটেল। নিচ তলায় দুটো রুম নিলাম আমরা। নিচ তলায় দেখলাম দরজা হাঁট খোলা রেখে স্বল্প বসনা এক নারী শুয়ে। ইউরোপের কোনো দেশ থেকে এসেছিলেন। দেখা হতেই হাই বলে হাত নাড়ালেন। শরীর তার পড়ে ছিল সেভাবেই। বোঝা গেল না তিনি ক্লান্ত, নাকি বিলাসিতায় মগ্ন।

ওই ইউরোপী রমণীর পাশের রুমে ঢুকলেন ফিরোজ আর মিলটন। আমি আর ইমন গেলাম অন্য পাশের একটি কক্ষে।

হাত মুখ ধুয়ে বেরিয়ে পড়লাম। খুব খিদে পেয়েছিল। পথ বেয়ে উপরে উঠলাম। একটি মাত্র রেস্টুরেন্ট। সেখানে ছিল কেবল ফ্রাইড রাইস। অর্ডার হলো। ২০ মিনিট পর খাবার সার্ভ হলো। ড্রাইভার নিলেন চিকেন। আমরা সবাই ডিম ভাজি আর ফ্রাইড রাইস।

লাঞ্চ শেষ করে রেস্টুরেন্টের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। অ্যাডামস পিক কোন দিকে? পশ্চিমে মুখ করে একজন দেখালেন এই দিকে। তখন বিকেলের সূর্য ঘন মেঘের আড়ালে। কেবল কাছের পাহাড়গুলোই দেখা যাচ্ছিল। লোকটি বলছিলেন, সূর্য থাকলে কিছুটা দেখাতে পারতাম। এখন কিছুই দেখা সম্ভব না। তাছাড়া ওই চূড়া প্রায় সব সময়ই মেঘে ঢাকা থাকে। আশপাশের মেঘগুলো ওই পাহাড়ে গিয়ে ধাক্কা খায়, ঝরে পড়ে। কেবল সৌভাগ্যবানরাই স্বচক্ষে আদম চূড়া দেখতে পারেন।

হোটেল কক্ষে আর ফিরলাম না। একটু পরেই সন্ধ্যা হবে। আদম পাহাড়ে উঠার আগে সবকিছু ভালো করে দেখে নেয়া দরকার। এত কথা শুনেছিলাম এই শ্রী পাদা বা আদম পাহাড় নিয়ে- সব মিলিয়ে একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। তাছাড়া পাহাড়ে উঠা শুরু করতে হবে মধ্যরাতের পর। অন্ধকারে কোথায় কি যাব না যাব..। সূত্র: রাইজিংবিডি।

স্ব.বা/শা

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *