বাগমারার আতঙ্ক বাহিনীর প্রধান জাবের গ্রেফতার

রাজশাহী লীড

বাগমারা প্রতিনিধি: বাগমারায় বিল, পুকুর দখল, চাঁদাবাজি ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এবার মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে উপজেলার বাসুপাড়া ইউনিয়নের দুই প্রভাবশালী গডফাদার। এদের একজন হলেন, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি লুৎফর রহমান। আরেকজন হলেন, লুৎফর রহমানের হাতই ধরেই উত্থান জাবের বাহিনীর প্রধান জাবের আলী।

এই দুজন এখন বাসুপাড়া ইউনিয়নে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব বাহিনী। সম্প্রতি এই দুই বাহিনীর পাল্টাপাল্টি হামলায় নারীসহ অন্তত ২০ জন আহত ও দুই জন পুঙ্গত্ববরণ করেছেন। এ নিয়ে উভয় পক্ষ থেকেই বাগামারা থানা ও রাজশাহীর আদালতে একাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে। এতে আসামী হয়েছেন অর্ধশতাধিক।

এসব মামলায় ইউনিয়নের মন্দিয়াল, তেগাছি, হলুদঘর, বীরকয়া, খয়েরা, কুতুবপুর, জোতিনগঞ্জসহ ১০ গ্রামের লোজনের মাঝে গ্রেপ্তার আতঙ্ক বিরাজ করছে। গ্রামগুলো এখন অনেকটা পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। আবার এখনো এলাকায় দুই বাহিনীর সদস্যদের মধ্যেই চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। এ নিয়ে আতঙ্কে এলাকাবাসী।

তবে নানা চেষ্টার পরে গত রাতে জাবের বাহিনীর প্রধান জাবেরসহ ৫জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

এ সব বিষয়ে জানতে চাইলে বাগমারা থানার অফিসার ইনচার্জ(ওসি) আতাউর রহমান জানান, দু’জনের (লুৎফর-জাবের) কারণেই এলাকায় অশান্তি বেড়ে চলেছে। এখনো হামলা-পাল্টাহামলার শঙ্কা রয়েছে। আমরা উভয় মামলাগুলো তদন্ত করে দেখছি। এছাড়া জাবেরসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তারেও অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

পুলিশ এলাকাবাসী ও ভুক্তভোগী মহল সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন চেয়ে হঠাৎ রাজনীতিতে আর্বিভূত হোন এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমান। এ কারণে তিনি স্কুলের চাকুরি থেকেও ইস্তফা দেন। স্থানীয় এমপি এনামুল হকের নিকটাত্মীয় হওয়ার সুবাধে তিনি সে সময় মনোনয়নও পেয়ে নির্বাচেন জয়লাভও করেন। প্রধান শিক্ষক থেকে ইউপি চেয়ারম্যান হয়েই লুৎফর রহমান নিজের প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেন। এর জন্য তিনি শিষ্য হিসেবে ওই এলাকার ত্রাশ জাবের আলীকে আশ্রয় দেন। ভোটে জেতার পর চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান নিজস্ব কিছু পুকুর নিয়ে মাছচাষও শুরু করেন। এ সময় তিনি মাছের খাদ্যের ব্যবসাও চালু করেন। শুরুতে এই মাছের খাদ্য বিক্রির দায়িত্ব দেন জাবের আলীর ওপর। এভাবে দিনে দিনে জাবের আলী চেয়ারম্যানের ক্যাডারে পরিণত হয়ে এলাকার বিল খাল ও পুকুর দখল করতে শুরু করেন।

স্থানীয়রা জানান, চেয়ারম্যান এই চতুর জাবেরের দ্বারা পশ্চিম নাককাটি, পূর্বনাককাটি, মরা বিলসহ বেশ কিছু বিল দখলে মরিয়া হয়ে ওঠেন। চেয়ারম্যানের প্রশ্রয় পেয়ে ক্যাডার হিসাবে জাবেরও হয়ে পড়েন অপ্রতিরোধ্য। এভাবে কয়েক বছরের মাথায় জাবেরের সুবাদে চেয়ারম্যান রাতারাতি কোটিপতি বনে যান। অপরদিকে একসময়ের দিনমজুর জাবেরও হয়ে উঠেন লাখোপতি। তবে গত ২০১৮ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা নিয়েও চরম ভরাডুবি হয় লুৎফর রহমানের। এ হারের পেছনে লৎফর রহমান সন্দেহ করেন শিষ্য জাবের আলীকে। আর তখন থেকেই শুরু হয় দু’জনের মধ্যে উত্তেজনা। নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে দু’পক্ষই আলাদা বাহিনী গড়ে তুলতে থাকেন।

এলাকাবাসী জানায়, এরই ধারাবাহিকতায় গত ৩ ডিসেম্বর জাবের বাহিনীর হামলার শিকার হন চেয়ারম্যানের অনুসারী বীরকয়া গ্রামের মোবারক হোসেন (৪৫)। জাবের বাহিনীর লোকজন পিটিয়ে তার হাত পা ভেঙে দেয়। বর্তমানে তিনি পুঙ্গত্ব জীবন-যাপন করছেন। এর সপ্তাহ খানেক আগে জাবের বাহিনীর লোকজন হামলা চালায় মোবারকের স্ত্রী আঞ্জুরী বেগমের (৩৫) উপর। তারা ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা চালিয়ে ঘুমন্ত আঞ্জুরী বেগমের ডান স্তন কেটে দেয়। এ ঘটনায় জাবেরসহ তার ১৭ ক্যাডার বাহিনীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। একইভাবে জাবের বাহিনীর হামলার শিকার হন কুতুবপুর গ্রামের আনোয়ার হোসেন(৫৫)। এই হামলায় আনোয়ার এক পা হারিয়ে এখন স্ক্যাচে ভর দিয়ে চলাফিরা করেন।

অন্যদিকে গত ১৯ ডিসেম্বর লুৎফর বাহিনীর লোকজন রাতের অন্ধকারে হামলা চালিয়ে জাবের বাহিনীর অন্যতম মোতালেব (২৫) নামে এক ভ্যান চালককে পিটিয়ে হাত পা ভেঙে দেয়। বর্তমানে ওই হামলায় মোতালেবও পুঙ্গত্ব জীবন-যাপন করছেন। ভ্যান চালাতে না পেয়ে তিনি এখন পরিবার নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দনি কাটাচ্ছেন।

এই হামলার ঘটনায় মোতালেব বাদী হয়ে লুৎফর বাহিনীর ১০ ক্যাডারের বিরুদ্ধে বাগমারা থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মোতালেব দাবি করেন, সাবেক চেয়ারম্যান লুৎফরের মাধ্যমেই উত্থান হয়েছে জাবেরের। কিন্তু এখন লুৎফর রহমান উল্টো জাবেরকে শায়েস্তা করতে নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে। এ কারণে আমাদের ওপরই চেয়ারম্যান বাহিনী হামলা করেছে।’

অন্যদিকে লুৎফর রহমান বলেন, ‘জাবের আলী একসময় আমার লোক ছিলেও এখন সে চরম দুর্বৃত্ত। পুলিশের উপর হামলা করে জাবেরকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সে এখন এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী।

এদিকে সন্ত্রাসীর গডফাদার জাবের আলীকে গ্রেপ্তারে অব্যাহত চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছে বাগমারা থানার পুলিশ। গত ১৯ ডিসেম্বর রাতে ইউনিয়নের জ্যোতিনগঞ্জ বাজার থেকে জাবের আলীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই সময় মোটরসাইকেলে করে জাবের আলীকে থানায় নেওয়ার পথে পুলিশকে ঘিরে ফেলে তার ক্যাডার। তারা পুলিশের উপর হামলা চালিয়ে দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে আহত করে হ্যান্ডকাফসহ জাবের আলীকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এর পর থেকে জাবের আলী আত্মগোপনে। তার খোঁজে পুলিশ ঢাকা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। শেষে গতকাল রাতে জাবেরকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় পুলিশ। সূত্র: সিল্কসিটি।

স্ব.বা/শা

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *