রাজশাহী নগরীতে চলছে ছিনতাই আর গ্রামের রাস্তা-ঘাট বেহাল

রাজশাহী লীড

স্টাফ রিপোর্টার: রাজশাহী নগরীতে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে গত ১৯ জানুয়ারি রাত দুইটার দিকে রামেকের দুই শিক্ষার্থী আহত হন। এসময় তাদের নিকট থেকে মোবাইল ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এর দুদিন আগে গোদাগাড়ীর এক অটোরিকশা চালককে নগরীর সাগরপাড়া এলাকায় ছুরিকাঘাত করা হয়। অটোরিকশা ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে ওই অটো চালক যুবককে ছুরিকাঘাত করা হয়। শহরের এই ছিনাতাই এখন যেন প্রতিদিনের ঘটনা।

রাজশাহী মহানগরীর একজন ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তা অনেকটা আক্ষেপ করেই বলছিলেন, ‘এমন কোনো দিন কাটছে না, যেদিন ছিনতাই হচ্ছে না। আর ছিনতাই হলেই আমাদের ওপর চাপ বাড়ে। কিন্তু কোনোভাবেই ছিনতাই রোধ করা যাচ্ছে না। এক শ্রেণির অটোরিকশা চালক ও মোটরসাইকেলরা এখন ছিনতাইয়ে জড়িত হয়ে পড়েছে। চলন্ত অবস্থায় তারা ছিনাতাই করে চলেছে। ফলে শহরের ছিনতাইকারীরা অনেকটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আর এতে চরম অস্বস্তিতে রয়েছেন নগরবাসী।

অন্যদিকে রাজশাহীর গ্রামাঞ্চলের বেহাল রাস্তাগুলোতে যাতায়াত করতে যেন নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ মানুষের। কোনো কোনো রাস্তা অনেকটাই যান চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তার পরেও চলাচল করতে হচ্ছে বিকল্প পথ না থাকায়। জনদুর্ভোগ লাঘবে তেমন কোনো উদ্যোগও চোখে পড়ছে না এলাকাবাসীর। এ নিয়ে চরম ক্ষোভ তৈরী হয়েছে সাধারণ মানুষের মাঝে। দ্রুতি রাস্তাগুলো সংস্কার করে এলাকাবাসীর দুর্ভোগ লাঘবেরও দাবি জানিয়েছেন অনেকেই।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছরের ৬ আগস্ট ভোরে ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে রাজশাহী সিটি কলেজছাত্র ফারদিন ইসনা আশারিয়া রাব্বীকে (১৯) হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ঘটনার পরের দিন মাদকসেবী ওই এলাকার বাসিন্দা কুদরত আলীর ছেলে রনককে (২৩) ৭ দশমিক ২ গ্রাম হেরোইনসহ গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে রনক স্বীকার করে কলেজছাত্র রাব্বীকে সে খুন করেছিল ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে। রাজশাহীতে গত ৫-৬ বছরে ছিনতাইরকারীর ছুরিকাঘাতে অন্তত ৫টি হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু পথচারী হত্যার ঘটনাটি প্রথম গত ৬ আগস্ট। এর আগের হত্যাকা-গুলো ছিলো অটোরিকশা ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একের পর এক ছিনতাই নিয়ে চরম অস্বস্তিতে পড়েছেন নগরবাসী।

নগরীর উপশহর এলাকার বাসীন্দা মাজহার আলী বলেন, ‘কয়দিন আগে আমার মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফেরার পথে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন। মোটরসাইকেল বাহিনী ছিনতাইকারীরা অটোরিকশার অপরে থাকা অবস্থায় ভ্যানেটি ব্যাগটি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। যার মধ্যে একটি মোবাইলসহ বেশকিছু টাকাও ছিল। কিন্তু সেগুলোর আর হদিশ পাওয়া যায়নি। এপর থেকে পরিবারের সব সদস্য ছিনতাই আতঙ্কে রয়েছেন। ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই ছিনতাইকারীদের কবল থেকে কিভাবে রক্ষা পাওয়া যাবে, সেটি ভেবেই বের হচ্ছি আমরা।’

রাজশাহীর একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এখন ছিনতাইকারীরা নানা কৌশলে ছিনতাইয়ে জড়িত হয়ে পড়েছে। ভোরে বা গভীর রাতে পায়ে হেঁটে, দিনের বেলা কেউ মোটরসাইকেল নিয়ে আবার কেউ অটোরিকশা নিয়ে ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ছে। এরা অনেকটাই বেপরোয়া। বড় কোনো ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটার পর উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা আমাদের মোটরসাইকেল ও অটোরিকশা তল্লাশির জন্য ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করেন। কিন্তু যেখানে হাজার হাজার অটোরিকশায় ভরে আছে শহর, সেখানে কয়টা তল্লাশি করা যায়। এগুলোর দ্রুত নিয়ন্ত্রণ না আনলে ছিনতাই রোধ করা সম্ভব না। আবার মোটরসাইকেলে ছিনতাইকারী বাহিনীর সদস্যরাও বেপরোয়া।’

এদিকে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সনাক) রাজশাহী জেলা শাখার সভাপতি আহম্মেদ শফিউদ্দিন বলেন, ‘রাজশাহী নগরীর ছিনতাই এখন খুব বড় বেদনাদায়ক। গত ছয় মাসে যেভাবে একের পর এক ছিনতাই হচ্ছে, তাতে শান্তির শহর রাজশাহীর নামই হয়তো এক সময় পরিবর্তন হয়ে গিয়ে ছিনতাইয়ের শহরে পরিণত হবে। কিন্তু এটি মেনে নেওয়া যায় না। এই ছিনতাইকারীদেও দ্রুতই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্রশাসন এবং আমাদের নগর সংস্থা ও রাজনীতিবিদরা একটু দৃষ্টি দিলেই শহরের ছিনতাই রোধ করা সম্ভব।’

তিনি বলেন, ‘শহরের প্রতিটি মোড়ে মোড়ে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো দরকার। শহরে কারা অটোরিকশা চালায়, তাদের বায়োডাটাসহ অটোরিকশার সামনে ঝুলিয়ে দিতে হবে। যেন একজন যাত্রী সহজেই সেই চালকের নাম-পরিচয় মনে রাখতে পারে বায়োডাটা দেখেই। আর মোটরসাইকেলযোগে ছিনতাইকারীদের নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে হবে প্রশাসনকে। কোনোভাবেই কিশোরদের মোটরসাইকেল চালাতে দেওয়া যাবে না শহরে। কারণ বেশিরভাগ ছিনতাইকারী এই কিশোররাই। তাহলেই রোধ হবে এই ছিনতাই।’

এদিকে রাজশাহীর হরিয়ান থেকে দুর্গাপুর পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার রাস্তাটা এতোটা ভয়াবহ হয়ে পড়েছে যে প্রায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। পথচারীরা সুযোগ পেলে বিকল্প রাস্তা ব্যবহার করছেন। কিন্তু এই রাস্তাটিও সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নাই।

রাজশাহীর মহেন্দ্রা বাজারের ব্যবসায়ী মুকুল হোসেন বলেন, এই রাস্তা দিয়ে এখন তেমন যানবাহন চলাচল করে না। একেবারে বিপদে না পড়লে এই রাস্তা ব্যবহার করছেন না মানুষ। রাস্তাটির এতো খারাপ অবস্থা হলেও সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নাই। ফলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগেরও সীমা নাই।

রাজশাহীর শুধু এই দুটি রাস্তাই নয়। গ্রাম-গঞ্জের রাস্তাগুলো দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের অভাবে চরম দুর্দশায় পরিণত হয়েছে অন্তত ২৫-৩০টি জনবহুল রাস্তা। কিন্তু এসব রাস্তা সংস্কারের তেমন উদ্যোগ নাই। আবার সংস্কার হলেও খুবই নিমাণের কাজ হওয়ায় এক মাসও থাকছে কার্পেটিং। এমনই অবস্থায় পরিণত হয়েছে রাজশাহীর বায়া থেকে তানোর সড়কটি।

রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, ‘গ্রামীণ সড়কগুলো সংস্কারের উদ্যোগ না থাকায় মানুষের কষ্ট দিনের পর দিন বাড়ছে। এসব রাস্তা দ্রুত সংস্কার জরুরী। আবার সংস্কার করলেই হবে না। কাজের মাণও যেন ভালো হয়, সেইদিন থেকে নিশ্চিত করতে হবে। না হলে সংস্কার করেও কোনো লাভ হবে না। দুদিন পরেই আবার একই অবস্থায় পরিণত। রাস্তাগুলো নির্মাণ বা সংস্কারের অনিয়মের কারণেই রাজশাহীর গ্রামীণ সড়ক এখন বেহাল অবস্থায় পরিণত হয়েছে।

শহরে ছিনতাই নিয়ে জানতে চাইলে মহানগর পুলিশের মুখপাত্র গোলাম রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘ছিনতাই কিছু কিছু ঘটছে। তবে এর জন্য আমাদের সকলের সচেতন হওয়া দরকার। ছিনতাই রোধে শুধু পুলিশ নয়, পথচারীদেরও এগিয়ে আসতে হবে। এই ধরনের কোনোকিছু ঘটার সঙ্গে আমাদের জানাতে হবে। প্রয়োজনে ছিনতাইকারীদের ছবি তোলার চেষ্টা করতে হবে।’

ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘ছিনতাই রোধে আমরা পুলিশ সদস্যদের নিয়মিত টহলের ব্যবস্থা করেছি। এটি এখন আরো জোরদার করা হয়েছে। তবে শহরের সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো দ্রুত সংস্কার করা দরকার। যেসব স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা নাই। সেসব স্থানে বসানো দরকার। তাহলে দ্রুত ছিনতাইকারী সনাক্ত করা যাবে এবং তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়াও যাবে। তাহলেই নিয়ন্ত্রণে আসবে ছিনতাই।

স্ব.বা/শা

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *