নাটোরে ঢাবি শিক্ষার্থী সুমাইয়ার হত্যাকারী স্বামী ও শশুর এখনও পলাতক

রাজশাহী
 নাটোর প্রতিনিধি: নাটোরে শহরের হরিশপুর এলাকায়  ঢাবির এক মেধাবী ছাত্রী সুমাইয়া খাতুনকে  হত্যার ঘটনায় মূল আসামি সুমাইয়ার স্বামী মোস্তাককে দু’দিনেও ধরতে পারেনি পুলিশ। এছাড়া শশুর জাকির হোসেনও পলাতক রয়েছেন। তবে পুলিশ বলছে তাদের ধরতে পুলিশ অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। যে কোন সময় তারা বাবা-ছেলে ধরা পড়বে। পুলিশের ভাষ্যমতে মোস্তাককে গ্রেফতার করতে পারলে এবং ময়না তদন্ত রিপোর্টের পর জানা যাবে আসলে কি ঘটেছিল। এদিকে সুমাইয়া হত্যার ঘটনার পর গ্রেফতারকৃত সুমাইয়ার শাশুড়ি সৈয়দা মালিকা বেগম ও ননদ জুই খাতুনকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
গত রোববার সুমাইয়ার মৃত্যুর পর কেউ বাদী না হওয়ায় পুলিশ একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠায়। কিন্তু সোমবার রাতে সুমাইয়ার মা নুজহাত সুলতানা বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় সুমাইয়ার স্বাামী মোস্তাক হোসেন, শশুর জাকির হোসেন , শাশুড়ি সৈয়দা মালিকা  এবং ননদ জুই খাতুনকে আসামী করা হয়। এই মামলার প্রেক্ষিতে পুলিশ সুমাইয়ার শাশুড়ি সৈয়দা মালিকা ও  ননদ জুই খাতুনকে গ্রেপ্তার করে। সুমাইয়ার পরিবারের দাবী গত রোববার রাতে তারা সুমাইয়াকে নির্যাতন করে বালিশচাপা দিয়ে হত্যা করে মরদেহ ঝুলিয়ে রেখে আত্মহত্যা হত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করে। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণার পর মোস্তাক পালিয়ে যায়।
থানায় অভিযোগ সুত্রে জানা যায়, শশুর বাড়ি থেকে চাহিদামত টাকা না পাওয়ায় বেকার মোস্তাক বেপরোয়া হয়ে উঠে। বাবার বাড়ি থেকে টাকা আনার জন্য বার বার চাপ দেয়। কিন্তু বাবার মৃত্যূর পরে সুমাাইয়া তার স্ট্রোকে আক্রান্ত মায়ের কাছে টাকা না চেয়ে নিজেই কিছু একটা করার চিন্তা করছিল। এজন্য সে প্রস্তুতি নিচ্ছেল বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার। মেধাবী সুমাইয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী স্টাডিজ বিভাগের ছাত্রী ছিল। সে অনার্স পরীক্ষায় প্রথম ম্রেণিতে উত্তির্ণ হয় এবং স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শেনিতে উত্তির্ণ হবে বলে  জানিয়েছেন তার শিক্ষকরা। আজ সেই পরীক্ষার ফল প্রকাশের কথা। তার আগেই সুমাইয়াকে চলে যেতে হলো না ফেরার দেশে। সুমাইয়াকে হত্যার পরে এটি আত্ম হত্যার ঘটনা বলে চালানোর চেষ্টা করে সুমাইয়ার শশুরের পরিবার।
পুলিশ ও নিহত সুমাইয়ার চাচা আহাম্মদ আলী বলেন,  মেধাবী ছাত্রী সুমাইয়ার বাবার বাড়ি নাটোর শহরের হরিশপুর এলাকায়। অপরদিকে স্বামী মোস্তাকের বাড়ি সুমাইয়ার বাড়ির অদুরেই বলারী পাড়া এলাকায়।একই এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় সুমাইয়ার সাথে মোস্তাকের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। এক পর্যায়ে পিতা মাতার অমতে ২০১৪ সালে মোস্তাককে বিয়ে করেন সুমাইয়া। বিয়ের পরে মনে কষ্ট হলেও মেয়ের উজ্জল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বিয়েটা মেনে নেন সুমাইয়ার বাবা মওলানা  সিদ্দিকুর রহমান যশোরী। তিনি জামাই মেয়েকে ঢাকায় রেখে তাদের সংসারের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করতেন। হরিশপুর বাগানবাড়ি এলাকার মোস্তাক হোসেন নিজেকে বুয়েট থেকে পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার পরিচয় দিলেও আসলে সে ডিপোলামা ইঞ্জিনিয়ার পাশ করে। চাকুরী না হওয়ায় বেকার ছিল সে। একারণে সে শশুরের টাকার ওপর নির্ভর করে চলতো।
  কিন্তু সম্প্রতি সুমাইয়ার বাবা সিদ্দিকুর রহমানের মৃত্যু হয় আট মাস আগে। সুমাইয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে খরচ দেয়া বন্ধ করে দেয়।তাছাড়া সুমাইয়ার ইসলামী স্টাডিজ বিভাগের স্নাতকোত্তর ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে যায়।  ফলে গত ৬ মাস ধরে মোস্তাক সুমাইয়াকে নিয়ে হরিশপুরের বাড়িতে বসবাস করে আসছিলেন। কিন্তু শাশুরী ,ও  ননদ নানাভাবে সুমাইয়াকে অত্যাচার করতো। অপরাদিকে  মোস্তাক টাকার জন্য সুমাইয়াকে চাপ দিত। কিন্তু সুমাইয়া বাড়ি থেকে টাকা না নিয়ে নিজইে কিছু করতে চেয়েছিলেন। সেকারণে সে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি সহ চাকুরীর চেষ্টা করছিলেন। এ নিয়ে মোস্তাকের সাথে তার বিরোধ লেগেই ছিল। আহাম্মদ আলী আরো বলেন   বড় ভাইয়ের মত্যুর পরে সুমাইয়া তার অত্যাচারের ঘটনা তাঁেক বলেতো।
কারণ সুমাইয়ার মা নুজহাত সুলতানা স্ট্রোকের রোগী। মেয়ের খারাপ কিছু সংবাদ থেকে মায়ের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কায় সুমাইয়া তার নির্যাতনের কাহিনী বাড়িতে বলতনা। সুমাইয়া ৭ মাসের গর্ভবতী ছিল। মোস্তাকের অথ্যাচারে সে সন্তান ভুমিষ্ট হওয়ার আগেই মৃতূ বরণ করে। এসময় সুমাইয়ার জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে। তার পরেও স্বাামীর সাথেই সংসার ও সুখী হতে চেয়েছিল।
 সুমাইয়ার মা নুজহাত সুলতানা বলেন, শুধু তাঁদের ঢাকায় থাকার খরচ নয় , সুমাইয়ার হরিশপুরের বাড়িতে দামি ফার্নিচার দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু মাস ছয়েক আগে তারা ঢাকা থেকে নাটোরে ফিরে আসেন। এরপর হরিশপুরে শশুর বাড়িতে বসবাস শুরু করেন।  গত রোববার রাতে স্বামী মোস্তাক সহ শশুর বাড়ির লোকজন সুমাইয়াকে নির্যাতন করে বালিশচাপা দিয়ে হত্যা করে মরদেহ ঝুলিয়ে রেখে আত্মহত্যা হত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করে। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণার পর মোস্তাক পালিয়ে যায়।  নুজহাত সুলতানা মেয়ের হত্যার সুষ্ঠ বিচার দাবি করে বলেন সুমাইয়া মেধাবী ছাত্রী ছিল ।
সে অনার্স পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করেছিল। তার স্নাতকোত্তর পলীক্ষার ফলাফল আজ প্রকাশ হওয়ার কথা। সে ভাল কিছু করতে চেয়েছিল সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অথবা বিসিএস দিয়ে একটি ভাল চাকুরীর প্রত্যাশা করছিল। কিন্তু ফল প্রকাশের  মাত্র কয়েকদিন আগে তাকে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হলো।  পাষন্ড স্বামী মোস্তাক সে আশা পূরণ করতে দিলনা। তিনি সুমাইয়া হথ্যার বিচার দাবি করেন।
সদর থানার ওসি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সুমাইয়ার শাশুরী সৈয়দা মালিকা বেগম জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে বলেছেন বিছানার ওপরে সুমাইয়াকে পড়ে থাকতে দেখে তারা তাকে নাটোর হাসপাতালে নিয়ে যান। তার আগে কি ঘটেছিল তা তারা জানেননা। প্রেমে করেই সুমাইয়া ও মোস্তাকের বিয়ে হয়েছিল। তারা একত্রে কিন্ডার গার্টেন স্কুল ও প্রাইভেট পড়ানোর কথা চিন্তা করছিল। কিন্তু করোনার কারণে সে কাজ তারা শুরু করতে পারেনি।
এদিকে বুধবার সরজমিনে শহরের বড় হরিশপুর মোস্তাকের বাবা জাকির হোসেন বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। বাড়ীর সদর দরজায় তাল দেখতে পাওয়া যায়। এলাকাবাসী জানায়, মোস্তাক কিছু করেনা বলেই তারা জানেন। তবে মোস্তাকের বাবা জাকির হোসেনের কয়েকবিঘা ধানী জমি রয়েছে যা দিয়ে তাদের সংসার চলে। তবে সুমাইয়ার মৃত্যু নিয়ে তারা কিছু জানেন না। প্রথমে শুনেছিলেন, সুমাইয়া আত্মহত্যা করেছে। তবে বিষয়টি তাদের কাছে বিস্ময়ের সৃষ্টি হলেও স্বামী- স্ত্রীর মান অভিমান থেকে এমন ঘটনা ঘটতে পারে তারা ভেবেছিলেন। পরে জানতে পারেন তাকে নাকি হত্যা করা হয়েছে। অসলে কি ঘটেছিল তারা সঠিকভাবে জানেননা।
নাটোরের পুলিশ সুপার লিটন কুমার বলেন, ঢাবির ইসলামী স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান তাকে ফোন করে জানিয়েছেন সুমাইয়া খুবই মেধাবী মেয়ে। সে স্নাতকোত্তের পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ পাবেন বলে আশাবাদী ছিলেন। চেয়ারম্যান মহোদয় সুমাইয়ার মৃত্যুটাকে দুঃখজনক বলে অভিহিত করেন । লিটন কুমার সাহা বলেন, পুলিশ আসামীদের গ্রেফতারে চেষ্টা চালাচ্ছে। ময়না তদন্ত রিপোর্ট এবং আসামি মোস্তাককে গ্রেফতার করতে পারলে মূল রহস্য বেরিয়ে আসবে। এ বিষয়ে সব ধরণের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তবে কেউ যেন বিনা কারনে সাজা ভোগ না করে সে  দিকটাও সর্তকতার সাথে দেখছেন।

স্ব.বা/বা

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *