পাঁচ টাকায় দুপুরের খাবার মেলে শিক্ষার্থীদের!

রাজশাহী লীড শিক্ষা

বাঘা প্রতিনিধি:
শিক্ষার্থীদের সস্তায় খাবার খাওয়াচ্ছেন একজন হোটেল ব্যবসায়ী। তিন বছর ধরে তিনি ৫ টাকায় দুপুরে খাবার খাওয়াচ্ছেন শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থীদের কষ্টের কথা মাথায় নিয়ে ৫ টাকায় দুপুরে খাবার প্যাকেজ চালু করেছেন উপজেলার আড়ানী বাজারের অন্নপূর্ণা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের স্বত্তাধিকারি। এই হোটেল ব্যবসায়ীর নাম বিপ্লব সরকার (৩৫)। তার বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানী পূর্বপাড়া গ্রামে।

আড়ানী পৌর বাজারের তালতলায় বড়াল নদের ধারে বিপ্লব সরকারের হোটেল। দুপুরে এই হোটেলে ৫ টাকায় খাবার খাওয়ানো হয় শুধুমাত্র আড়ানী মনোমোহিনী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থীদের স্কুল ড্রেস থাকলে এই টাকায় খাবার পাওয়া যায়। তবে স্কুল ড্রেস পরিহিত শিক্ষার্থীদের কেউ যদি বাইরে মুখরোচক কোন খাবার খাই,সেই সব শিক্ষার্থীরা ৫ টাকার খাবার প্যাকেজ পাবেনা। এই দুই শর্তে খেতে দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের। এছাড়াও সাশ্রয়ী মূল্যেও খেতে পারেন সাধারনরা।

অন্নপূর্ণা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুন্টের মূলত মালিক বিপ্লব সরকারের বাবা শ্যামল সরকার। ১৯৭১ সালে বিপ্লবের বাবা শ্যামল সরকার আড়ানী বাজারে খাবার হোটেলটি প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময় ৭১ সালের মুক্তি যোদ্ধাদের কোনো কোনো সময় খাবার সরবরাহ করতেন শ্যামল সরকার। তার ছেলে বিপ্লব সরকার তিন বছর ধরে আড়ানি সস্তায় দুপুরে খাবার খাওয়াচ্ছেন শিক্ষার্থীদের। এ বিষয়টি এলাকার লোকজনের নজরে এলে সবার কাছে প্রশংসিত হয়েছেন তিনি। তবে বিপ্লব সরকার বলেছেন প্রশংসার জন্য তিনি এ কাজটি করছেন না। একজন মানুষ হিসেবে ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে খাবার প্যাকেজটি চালু করেছেন। তার বাবাও বিষয়টি জানতেন না। ২ বছর পর জেনেছেন। কিন্তু কোন আপত্তি করেননি।

সোমবার (০৬-৫-১৯) হোটেলে বসে এ বিষয়ে কথা হলে বিপ্লব সরকার বলেন, গ্রামের অধিকাংশ বাচ্চাই বাড়ি থেকে টিফিন নিয়ে আসেনা। বেশি টাকা দিয়ে হোটেলে দুপুরের খাবার কিনে খাওয়ার মতো সামর্থ্যও নেই অনেকের। স্কুলে এসে টিফিনের সময় আশপাশের দোকান থেকে মুখরোচক কিছু একটা কিনে খেতে দেখেছেন। যার দাম ৫টাকা থেকে ১০ টাকার মধ্যে।

কিন্তু সেগুলো স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। সেই থেকে মাথায় চিন্তা পেয়ে বসলো এই টাকায় যদি টিফিনের সময় দুপুরে একটু ভাত খেতো তা হলে তাদের শরীরটা ভালো থাকতো। এই চিন্তা থেকেই বাবার অগোচরে তিনি খাবার এই প্যাকেজ চালু করেন। ড্রেস পরে শিক্ষার্থীরা স্কুলে এলেই ৫ টাকায় খাবার খাইয়ে দিতেন। বিষয়টি জানার পর শিক্ষার্থীরা খেতে আসতে শুরু করে। আগের তুলনায় ৫ টাকায় খাবারের শিক্ষার্থী খদ্দের অনেক বেশি।

৫ টাকার খাবারে কি কি দেওয়া হয় জানতে চাইলে বিপ্লব সরকার বলেন, শরীরের জন্য সবজির বড় প্রয়োজন। তাই পরিমান মতো ভাতের সঙ্গে সবজি আর ডাল দিয়ে একটি প্যাকেজ তৈরি করেছেন। কোনো বাচ্চা সবজি নষ্ট না করে সে দিকে তিনি খেয়াল রাখেন। টমেটোর মৌসুমে টমেটোর সালাদ খেতে বাধ্য করেন এই প্যাকেজে। তিনি দেখেছেন বেশির ভাগ বাচ্চাই পুরো প্লেট ভাত খেতে পারেনা।এতে তার লোকসান হয়না। তবে পাশাপাশি খেতে বসে কোনো বাচ্চা যদি বেশি টাকা দিয়ে মুরগির মাংস খেতে চায়। তাহলে তিনি পাশের বাচ্চাটাকেও ছোট এক টুকরা মুরগির মাংস ও একটু ঝোল দেন। যাতে তার মন খারাপ না হয়। বেশির ভাগ সময়ে তাকেই হোটেল দেখা শোনা করতে হয়। তাঁর বাবা বিকেলে বসেন।

বিপ্লব বলেন, সংসারের অভাব-অনটনের কারণে তাঁর এসএসসি পরীক্ষাটা দেওয়া হয়নি। এখন লেখা পড়া না করার ভুলটা বুঝতে পারছেন। এজন্য যে বাচ্চারা লেখাপড়া শিখছে, তারা যেন শারীরিক ভাবে সুস্থ থাকতে পারে, তার জন্য তিনি তাঁর সাধ্যের মধ্যে যতটুকু পারছেন, সহযোগিতা করছেন। সেবার মানসিকতা থেকে মনের আনন্দে তিনি এটা করছেন। ছোট ছোট ছেলের দুপুরে এ টাকার বিনিময়ে খাবার দিতে পেরে ভালো লাগে। আর হোটেলে বাবাকে সহযোগিতাও করেন। এ ব্যবসার পাশাপাশি লেপ-তোশকের দোকান রয়েছে তার।

অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাবিহা ও অবনি জানান, ওই হোটেলে গিয়ে খাবার খেলে সর্বনি¤œ ৫ টাকার বেশি নিতো না। যা দেখে অবাক হতাম। ৫টাকায় যে খাবার দেয়, তাতে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর মুখরোচক খাবারের চেয়ে অনেক ভালো। সাধারন খদ্দেরের একজন সামসুল হক দুপুরে খাচ্ছিলেন এই হোটেলে। তিনি জানালেন কম টাকার মধ্যে যে খাবার দেয়,তাতে ভাত,ডিম, সবজি ও ডাল থাকে।

দেখা গেল হোটেলটিতে একজন মাত্র কর্মচারি রয়েছে। যার কারণে খাবার সরবরাহ থেকে শুরু করে টাকাও নিতে হয় বিপ্লব সরকারকে। তাই মালিকের টেবিল থাকে ফাঁকা।

বিপ্লব সরকারের বাবা শ্যামল সরকার বলেন, ছেলের এ কাজের কথা জেনে তাকে অনেক বকাবকি করেছেন। বকাবকি করেও যখন কোনো কাজ হলো না, হোটেলের দায়িত্ব ছেলেকে দিয়ে দিলাম। তবে ভালো চলছে।

আড়ানী মনোমোহিনী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সঞ্জয় কুমার দাস ৫ টাকার খাবার প্যাকেজ সম্পর্কে বলেন, তিনি তাঁর স্কুলের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে শোনার পরে রোববার দুপুরে দেখতে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে অবাক হয়েছেন,৫ টাকায় খাবার খেতে দিয়ে মানবতার পরিচয দিয়েছেন বিপ্লব সরকার।

মনোমহিনী সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও আড়ানী পৌরসভার সাবেক মেয়র নজরুল ইসলাম বলেন, মাঝে মধ্যে তার হোটেলে দুপুরে খেতে গিয়ে, সেখানে দুৃপুরে ভাত খাওয়ার জন্য স্কুলের ছেলে মেয়েদের দেখেছেন। পরে জানতে পারেন ৫ টাকার বিনিময়ে ছাত্রদের খাবার দেয়া হয়।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *