আল-আফতাব খান সুইট, নাটোর প্রতিনিধিঃদিনমজুর মা মমতাজ ও বাবা ইসরাইল বাণী ঘর আলো করে নানার বাড়িতে জন্ম নেয় ফুটফুটে একমাত্র পুত্র সন্তান। ভালোবেসে তার নাম দেওয়া হয় মহাতাব উদ্দিন ওরফে মহাতাব।
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস তার জন্ম হয় শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে। তাতেও কোনো দুঃখ ছিলোনা মায়ের মনে। কিন্তু মহাতাবের বয়স যখন মাত্র ১ মাস তখন একটা দুঃসংবাদে সেই আলোকিত ঘর বৈশাখের কালো মেঘ আর মাঘ মাসের ঘন কুয়াশার মতো অন্ধকারে ছেঁয়ে আসে।
তারা জানতে পায় তাদের আদরের নবজাতক সন্তান মহাতাব প্যারালাইজডে পঙ্গু হয়ে গেছে। অন্যদের মতো সে নিজের পায়ে ঠিক করে দাড়াতে বা হাটতে পারবেনা। উন্নত চিকিৎসা করালে হয়তো কিছুটা সেরে উঠতে পারে। অনেক টাকা লাগবে দীর্ঘমেয়াদী সেই চিকিৎসায়। এ যেন পূর্ণিমাতে আমাবর্ষার ছাপ। মহাতাবের মা-বাবা দু’জনই দিনমজুর হওয়ায় সেই পঙ্গু ছেলের চিকিৎসা করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। ছেলের চিকিৎসা করতে গিয়ে সংসারের নেমে আসে অভাব-অনটন। আর তখনই স্ত্রী-পুত্র ফেলে রেখে চলে যায় জন্মদাতা বাবা ইসরাইল বাণী। সন্তান পঙ্গু বলে স্বার্থপরের মতো ছেঁড়ে যেতে পারে বাবা। কিন্তু মা নিজের বুকের ধন, চোখের মণি হিসেবে বুকে আঁকড়ে ধরেছেন সেই সন্তানকে।
বলছিলাম নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার পাঁকা ইউনিয়নের চক গোয়াশ গ্রামের মা মমতাজ ও তার ছেলে প্রতিবন্ধী অটোভ্যান চালক মহাতাব উদ্দিন ওরফে মহাতাব (৩৪) এর কথা। মমতাজ ওই গ্রামের মৃত মোজাফফরের মেয়ে (৫৩) সরেজমিনে জানা যায়, মহাতাবের ১ মাস বয়স থেকে তার মা-বাবার দ্বায়িত্ব পালন করে আসছেন মমতাজ। ইচ্ছা ছিল ছেলেকে শিক্ষিত করবেন। কিন্তু অভাবের কারণে সে স্বপ্নও ভেঙে যায় মমতাজ বেগমের। ষষ্ঠ শ্রেণীর বেশি লেখাপড়া করাতে বা শিক্ষিত করতে পারেননি। কিন্তু মানুষ হিসেবে ঠিকই তৈরী করেছেন নিজের সন্তানকে। ছেলেকে কখনো বাবার অভাব বুঝতে দেননি তিনি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ছেলের জন্য প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করে নিয়েছেন।ছেলের বিয়েও দিয়েছেন মা মমতাজ। ছেলের ঘরে ৩ বছরের একটা নাতিও আছে।
প্রতিবন্ধী ভাতা হিসেবে প্রতিমাসে ৭৫০টাকা করে পায়। সেই ভাতার টাকা আর দিনমজুরি করে বাড়িতেই ছোট একটা মুদি দোকান করেছিলেন। কিন্তু দোকান চালাতে অনেক অর্থের প্রয়োজন। দীর্ঘদিন দোকান চালানোর পরে টাকার যোগান দিতে না পারায় দোকানটি বন্ধ করে দিতে হয়েছে। বর্তমানে ব্যাটারিচালিত অটোভ্যান চালক প্রতিবন্ধী মহাতাব। প্রায় ৫ বছর ধরে অটোভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি। মা-ছেলের পরিশ্রমের ফসল হিসেবে বাড়ি করার জন্য সাড়ে চার শতক জমি কিনেছেন। এরসাথে মমতাজের বাবা দিয়েছেন আড়াই শতক জমি। কিন্তু বাড়ি করতে পারেননি টাকার অভাবে। একটা মাত্র শোবার ঘর। তাও একটুখানি বৃষ্টি হলেই ঘরের ভেতর পানিতে ভরে যায়। ঝড়ে ছোট্ট ছাপরা ঘরটি দোল খায়। মনে হবে এই বুঝি ভেঙে পড়বে বা বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। ছেলে প্রতিবন্ধী ভাতা পায় সেজন্য সরকারি বা বেসরকারি আর কোনো অনুদান তারা পাইনা। এমনকি করোনা কালীন সময়েও তাদেরকে কোনো প্রকার সাহায্য বা অনুদান দেওয়া হয়নি।
মমতাজ বেগমের কথা, আমার ছাওয়ালের বয়স যখন ১ মাস তখন অর বাপ (ইসমাইল) আমাদের ফেলি চোলি গিছে। কথা প্রসঙ্গে, আমার বিয়া হইছিল ওইযে রাসশায়ের (রাজশাহী) চারঘাট থানার শারদায়। (তবে কতো বছর আগে বিয়ে হয়েছিল সেটা তার মনে নেই) আমি ৩৪ বচ্ছর ধোরি আমার বুকে আগলি রাখি, আমার একমাত্র মানিককে (মহাতাব) বড় করিছি, সৎপথে চলার শিক্ষা দিছি। এই এলাকার একজন মানুষও বুলতে পারবিনা যে, আমার ছেলি খারাপ বা কারো সাথে বিয়াদবি করিছে। অর (মহাতাব) জন্য খুব ভয় হয়, সারাদিন রাস্তায় থাকে ভ্যান লিয়া। হয়তো কেউ আসি বুলবে, তোমার ছেলির এক্সেন্ড হইছে। এই কথা বলেই কেঁদে ফেলেন মমতাজ।
আর সাংবাদিকদের অনুরোধ করে বলেন, আপনেরা একটু দেখেন আমার ছেলিডার কিছু কোরতে পারেন নাকি। আমাদের থাকার মুতন ঘর নাই। সরকারেক বুলি যদি কোরি দিতে পারেন।
রাস্তায় দেখা হয় মহাতাবের সাথে কথা হয় সেখানেই। তিনি বলেন, মায়ের কাছে শুনেছি, আমার বয়স যখন ১ মাস তখন আমার বাবা আমাকে আর মাকে রেখে পালিয়ে গেছে। আজ পর্যন্ত আমাদের কোনো খবর সে রাখেনি। শুনেছি আমার দাদার বাড়ির ওখানে নাকি আরো কয়েকটা বিয়ে করেছে। সে বেঁচে আছে কিনা তাও আমারা জানিনা। বাবা কেমন হয় সেটা আমি জানিনা। তবে বাবার অভাব কোনদিনই বুঝতে দেয়নি আমার মা। কথা প্রসঙ্গে এক সময় মহাতাব বলেন, আমি পঙ্গু, আমি প্রতিবন্ধী তাই বলে জীবন যুদ্ধে আমি হার মানিনি। প্রাইমারি স্কুলে পড়েছি, “নবীজির শিক্ষা করোনা ভিক্ষা” নবীজির সেই কথা আর আমার মায়ের আদর্শে আমি মানুষ হয়েছি। পঙ্গু বলে নিজেকে ছোট করে দেখিনি। প্রতিবন্ধী বলে ভিক্ষাবৃত্তিকে বেছে নেইনি। কারো কাছে হাত পেতে খাবারের যোগাড় করিনা। ভিক্ষা করা আমি পছন্দ করিনা। আমি সৎপথে রোজগারের জন্য ভ্যান চালিয়ে আয় করি।
চারিদিকে এত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, সেটা নিয়ে আমার মা ও পরিবারের লোকজন আমার জন্য অনেক দুশ্চিন্তা করে। আমারও চিন্তা হয় কারণ আমিতো প্রতিবন্ধী নিজেকে সামলিয়ে চলাটা অনেক কঠিন। আমি যদি বাড়িতেই একটা স্থায়ী দোকান করতে পারি তাহলে আমার পরিবারের সকলের দুশ্চিন্তা দূর হবে এবং আমার জন্যও অনেক ভালো হবে। কিন্তু থাকার মতো ঘরই নেই দোকান কোরবো কি করে। থাকার বাড়ি আর দোকান করার মতো অর্থ, সামর্থ্য কিছুই নেই আমার।
আমাকে যদি কোনো বিত্তবান বা সরকার বাড়ি আর দোকান করার মতো ব্যাবস্থা করে দেন তাহলে আমাদের অনেক উপকার হবে। মায়েরও বয়স হয়েছে আর কতদিন দিনমজুরের কাজ করবে? আপনারাই বলেন আমি পঙ্গু না হলেতো আমার মাকে এত কষ্ট করতে হতনা তাইনা? এমন কথা বলতেই মহাতাবের দিকে তাকিয়ে দেখি তার দুই চোখ পানিতে ছলছল করছে।
“মা ও পঙ্গু ছেলের গল্পটার” ইতি টানতে না পারায় সকলের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। অনেক কিছু লেখার ছিল। কিন্তু শেষ করবো কি করে বুঝে উঠতে পারলাম না। তাই পাঠক আপনাদের উপর ছেড়ে দিলাম এই মা-ছেলের গল্পের ইতি টানার জন্য”।