রাজশাহীর সিটি কর্পোরেশনের বিতরণ করা ইফতার খেয়ে মানুষের ডাইরিয়া

রাজশাহী লীড

স্টাফ রিপোর্টার: বারান্দায় বাবা স্বপন শুয়ে আছেন। তাঁর পাশে চার বছরের ছেলে শাহনেওয়াজকে একটা কাটা কাপড় পরিয়ে রাখা হয়েছে। মা জুলেখা বেগম বললেন, ছেলে প্যান্ট খোলার সময় দিচ্ছে না। তাই তাকে কাটা কাপড় পরিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি নিজেও সকাল থেকে পাঁচবার বাথরুমে গিয়েছেন। এখন হাত-পা কাঁপছে। তিনি একা আর সামাল দিতে পারছেন না। তাই তার মাকে আসার জন্য ফোন করছেন।

আজ শুক্রবার রাজশাহী নগরের আহাম্মেদনগর মিলপাড়া এলাকার একটি বাড়িতে গিয়ে এই অবস্থা দেখা যায়। মহল্লার ঘরে ঘরে এই চিত্র। পাশের মহল্লা ফরিদাবাদেও এই অবস্থা। আক্রান্ত ব্যক্তিরা বলছেন, তাঁরা সবাই সিটি করপোরেশনের বিতরণ করা ইফতার খেয়েছিলেন।

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পবিত্র রমজান ও কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে মাসব্যাপী ইফতার বিতরণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজশাহী মহানগরের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের আলিফ লাম মিম ভাটা মোড়ের ওই দুই মহল্লার ৫০০ গরিব, অসহায় ও নিম্ন আয়ের ছিন্নমূল মানুষের মাঝে ইফতার ও মাস্ক বিতরণ করা হয়েছে। ইফতারের প্যাকেটে বিরিয়ানি, একটা ডিম, এক টুকরা মাংস ও দুটি খেজুর ছিল।

ইফতার বিতরণকালে উপস্থিত ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নাইমুল হুদা, মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোস্তাক হোসেন ও আহসানুল হক, আইন সম্পাদক মোসাব্বিরুল ইসলাম, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক ফিরোজ কবির, রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আবদুল মমিন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মীর তৌহিদুর রহমান, রাজশাহী কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক আবদুল ওয়াহেদ খান, মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রকি কুমার ঘোষ ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হাসান, মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি জহরুল ইসলাম প্রমুখ।

আজ শুক্রবার সকালে প্রথম আলো অনুসন্ধানে জানা যায়, আহাম্মেদনগর মিলপাড়া ও ফরিদাবাদ দুই মহল্লায় কথা বলে এমন একজন মানুষও পায়নি, যিনি ওই ইফতার খাওয়ার পর ভালো আছেন। সিটি করপোরেশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিমতে, ওই দুই মহল্লায় যেহেতু ৫০০ বিরিয়ানির প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে, তাহলে পরিস্থিতি কতটা ব্যাপক তা অনুমেয়। সকালে খবর পাওয়া যায়, পাড়ার মোড়ের ওষুধের দোকানগুলোতে মানুষ স্যালাইন কিনতে ভিড় করছেন।

বেলা ১১টার দিকে মিলপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, ঘরে ঘরে মানুষ পড়ে রয়েছেন। মহল্লার মানুষের মুখে মুখে একই কথা। মিলপাড়ার নাসিমা বেগমের দোকানে শিশুসন্তানকে সঙ্গে করে স্যালাইন কিনতে এসেছিলেন রোকসানা বেগম (১৮)। তিনি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলেন না। পেটের ব্যথায় কোঁকাচ্ছিলেন। বললেন, বমি আর পাতলা পায়খানা করতে করতে রাতে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। ইফতারের বিরিয়ানি হজম হয়নি। ওই রকমই বের হচ্ছে। তাঁর বাচ্চাকে ডিমটা দিয়েছিলেন। তার কিছু হয়নি। ডিমটা ভালো ছিল।

রোকসানা মহল্লার ভাড়াটে। তাঁর স্বামী আবুল একটি ফার্নিচারের দোকানে কাজ করেন। তাঁদের বাড়ি নাটোরের বড়াইগ্রামে। দোকানের সামনে দাঁড়িয়েই মাকে আসার জন্য ফোন করছেন। তিনি বলেন, রাতেই এই দোকান থেকে ১০টা স্যালাইন কিনেছেন। হাতে নগদ টাকা নেই। তাই নাসিমা বেগমকে স্যালাইনের দাম খাতায় লিখে রাখার জন্য অনুরোধ করলেন।

চা-দোকানি মকবুল হোসেন (৫০) ও তাঁর স্ত্রী মিনি বেগম হাত-পা ছেড়ে দিয়ে শুয়ে রয়েছেন। তাঁদের ছেলের বউ নগরের কয়েরদাঁড়া এলাকা থেকে এসেছেন শ্বশুর-শাশুড়িকে দেখাশোনা করার জন্য। তিনি বলেন, বাথরুমে যেতে যেতে তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ি কাহিল হয়ে পড়েছেন।

পাড়ার বাসিন্দা নয়ন (৩৫) বলেন, মানুষ ত্রাণের চাল নেওয়ার জন্য যেমন হুমড়ি খেয়ে পড়েন, সকালে পাড়ার ওষুধের দোকানের সামনে তেমন ‘চাইলের ভিড়’ লেগে গিয়েছিল। তিনি বলেন, তাঁর আট বছরের মেয়ে আর উঠতে পারছে না। তবে তাঁর স্ত্রী রওশন আরা বেগম তিনবার বাথরুমে যাওয়ার পর কোনোমতে সামলে নিয়েছেন।

মনোয়ারা বেগমের ছেলে এম এ কে ফেরদৌস নগরের বিসিক এলাকার একটি দোকানের বিক্রয়কর্মী। তিনি পড়ে রয়েছেন। বিছানায় তাঁর পাশে শুয়ে রয়েছে নয় বছরের মেয়ে জান্নাতুন ফেরদৌস। তাঁদের অবস্থা খুবই কাহিল। তবে ছেলের বউ কনা আক্তার একটু ভালো আছেন। মনোয়ারা বলেন, তাঁর নাতনিটা হাত শুকানোর সময় দিচ্ছে না। বাথরুমে যেতেই হচ্ছে।

নগরের ফিরোজাবাদ এলাকায় এসে ঘরে ঘরে মানুষের একই চিত্র দেখা যায়। পাড়ার মোড়ের দোকানি জুলফিকার রহমান বলেন, সকাল থেকে শুধু স্যালাইন আর চিড়াই বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, তিনি ওই ইফতার খাননি। যে খেয়েছে, তার কমবেশি ঝামেলা হয়েছেই।

এ ব্যাপারে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামানের ব্যক্তিগত সহকারী আবদুল ওয়াহেদ খান বলেন, প্রতিদিন ১ হাজার ২০০ লোকের জন্য ইফতার রান্না করে তিন জায়গায় বিতরণ করা হয়। কোথাও এ রকম হয়নি। একটা হাঁড়ির বিরিয়ানিতে দুর্ঘটনাবশত কিছু পড়তে পারে। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত দু-তিনজনের হাসপাতালে যাওয়ার খবর তিনি পেয়েছেন। এত আক্রান্তের কথা শোনেননি। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।

সিটি করপোরেশন কী ব্যবস্থা নেবে প্রশ্নে তিনি বলেন, মেডিকেল টিম নিয়ে ওই দুই মহল্লায় গিয়ে আক্রান্তদের চিকিৎসা ও ওষুধ দেওয়া হয়েছে। আজ থেকে রান্নার সময় আরও সতর্কতা অবলম্বন করা হবে এবং কেন এই দুর্ঘটনা ঘটল, তা খতিয়ে দেখা হবে।

জানতে চাইলে রাজশাহীর সিভিল সার্জন কাইয়ুম তালুকদার বলেন, ‘ফুড পয়জনিং হতে পারে। এখন তো গরম, খাবার কখন রান্না হয়েছে সেটি দেখার বিষয়।’ আক্রান্তদের করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, খাওয়ার স্যালাইন খাবে। বেশি অসুস্থ বোধ করলে হাসপাতালে যাবে। সূত্র: প্রথম আলো

 

স্ব:বা/না

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *