রাজশাহী বিএমডিএ’র কোটি কোটি টাকা লোপাটসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ

রাজশাহী লীড

স্টাফ রিপোর্টার: নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) ভেতরে চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে। কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর সিন্ডিকেট বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছে। বিপুল অঙ্কের টাকার অডিট আপত্তি রয়েছে। দায়সারা গোছের কোনো কোনো অডিট আপত্তি নিয়েও উঠেছে আপত্তি।

বেতন বৃদ্ধি, খাল খনন, কোটেশন, টেন্ডার, বিদ্যুৎ ব্যবহার, ভ্যাট কর্তনসহ নানা কাজে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে বিএমডিএ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অডিট টিম অডিট আপত্তি দিলেও একই কাজ করে চলেছেন তারা। ফলে সরকারের কোটি কোটি টাকা লোপাট ও তছরুপ হচ্ছে।

অভিযোগ উঠেছে, চার বছরের বেশি সময় ধরে ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে এসব অন্যায়-অপকর্মের নাটের গুরুতে পরিণত হয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবদুর রশিদ। এতে করে বিএমডিএতে এখন অনিয়মই নিয়মে পরিণত হয়েছে বলে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ও ভুক্তভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

অনুসন্ধানে ও সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ২০১৫-১৬ সালে অনুমোদিত জনবল অপেক্ষা অতিরিক্ত জনবল নিয়োজিত রেখে বেতন ভাতাদি পরিশোধ করায় কর্তৃপক্ষের ১২ কোটি ৩৯ লাখ ৯ হাজার ৩৭৯ টাকার ক্ষতি হয়েছে। বিএমডিএ’র প্রধান কার্যালয় রাজশাহীর ২০১৫-১৬ সালের এ হিসাবটি ২০১৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত নিরীক্ষা করা হয়। এটি নিরীক্ষা করে বাণিজ্যিক অডিট অধিদফতরের রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের একটি অডিট টিম।

এতে অর্গানোগ্রাম, কর্মরত জনবল, আয়-ব্যয় বিবরণী ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য রেকর্ড পত্রাদি যাচাই করে নিরীক্ষাকালে অডিট টিম দেখতে পায়, সংস্থাপন মন্ত্রণালয় ১৯৯৫ সালে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) সাংগঠনিক কাঠামোতে ৭১১টি পদ অনুমোদন করে কৃষি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। এর মধ্যে ৩৬টি কর্মকর্তা ও ৬৭৫টি কর্মচারীর পদ রয়েছে। পরবর্তীতে কিছু পদকে কর্মকর্তা (উপসহকারী প্রকৌশলী) পদে হওয়ায় মোট কর্মকর্তার পদ দাঁড়ায় ৭৫টি এবং কর্মচারী পদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৩৬টি।

এসব পদের বিপরীতে ২০১৫-১৬ সালে বিএমডিএ প্রধান কার্যালয় রাজশাহী ও এর আওতাধীন অফিসগুলোয় ২৫৪ জন কর্মকর্তা ও ৬৬৯ জন কর্মচারীসহ মোট ৯২৩ জন নিয়োজিত রেখে বেতন ভাতাদি পরিশোধ করা হয়। ফলে অনুমোদিত জনবল অপেক্ষা অতিরিক্ত ১৭৯ জন কর্মকর্তা ও ৩৩ জন কর্মচারীসহ মোট ২১২ জন নিয়োজিত রেখে বেতন ভাতাদি পরিশোধ করায় কর্তৃপক্ষের এ বিপুল অর্থ ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু এ টাকা এখনো অনাদায়ী রয়ে গেছে বলে সূত্রটি জানিয়েছে।

বিএমডিএ’র নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, উচ্চতর গ্রেডে অতিরিক্ত বেতন ভাতা গ্রহণ করে পিআরএলে (অবসর) চলে গেছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি অংশ। বিষয়টি জানাজানি হলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আরেকটি অংশ পিআরএলে ঝুলে আছেন এবং তারা হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। আর উচ্চতর গ্রেডে অতিরিক্ত (প্রাপ্যতার চেয়ে বেশি) বেতন ভাতা গ্রহণ করে চলেছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি অংশ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, পরিকল্পিত ও ইচ্ছাকৃতভাবে অতিরিক্ত (প্রাপ্যতার চেয়ে বেশি) বেতন ভাতা গ্রহণ করা হয়েছে, যা অব্যাহত আছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরো জানা গেছে, বিএমডিএ’র বাণিজ্যিক অডিট শাখা ২০১২-১৭ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের দায়সারা একটি অডিট করে। এ অডিটেই উঠে এসেছে ৬ কোটি ৬৯ লাখ ৮৫ হাজার ৫৭৯ টাকার অনিয়মের তথ্য। বিএমডিএ’র ২৪টি খাতে এ বিপুল পরিমাণ টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। তবে পূর্ণাঙ্গ ও সঠিকভাবে অডিট করা হলে বিভিন্ন খাতসহ বিএমডিএতে ওই পাঁচ বছরেই আরো কয়েক কোটি টাকা লোপাটের তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে সূত্রটি দাবি করেছে।

তবে এই ক্ষতির পরিমাণ আরো কয়েক গুণ বেশি হবে বলে সংস্থাটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী দাবি করেছেন। তাদের দাবি, বিএমডিএর বাণিজ্যিক অডিট শাখা ছাড়াও সরকারি অডিটেও উঠে এসেছে নানা অনিয়মের চিত্র। আবার অডিট কর্মকর্তাদের উৎকোচের বিনিময়ে ম্যানেজ করে কখনো কখনো পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিলেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। একই সাথে দায়সারা অডিটের মাধ্যমে কাউকে কাউকে কিছুটা দায়মুক্তি দেয়ার প্রবণতা দেখা গেছে বলেও অভিযোগ করেন একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী।

নথিপত্র পর্যালোচনাকালে দেখা যায়, ২০১৫ সালের ৯ এপ্রিল নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মচারীদের পক্ষ থেকে বাণিজ্যিক অডিট অধিদফতরের মহাপরিচালক মো: আফতাবুজ্জামান ও রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপপরিচালক মো: কামরুজ্জামান বরাবর স্বাক্ষরবিহীন একটি লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়। এতে বিএমডিএ’র কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টাইম স্কেল, সিলেকশন গ্রেড এবং বেশি স্কেলে বা ওপরের ধাপে বেতন গ্রহণের জন্য প্রতি বছর অডিট পার্টিকে বিশাল অঙ্কের ঘুষ প্রদান বন্ধের আবেদন করা হয়। এতে আরো উল্লেখ করা হয়, আমরা গরিব কর্মচারী, আমরা প্রতি বছর কেন আমরা ঘুষ দেবো। আমরা যা পাবো, তাই নেবো। তবুও ঘুষ দেবো না।

এ দিকে বাণিজ্যিক অডিট অধিদফতরের রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের দু’টি অডিট টিম বিএমডিএ’র প্রধান কার্যালয় ও রাজশাহী সার্কেলের আওতাধীন ২৩টি এবং প্রধান কার্যালয়ের আওতাধীন রংপুর ও ঠাকুরগাঁও সার্কেলের ৩৩টি দফতর বা জোনের নিরীক্ষা কার্যক্রম চালায়। এর মধ্যে বিএমডিএ’র প্রধান কার্যালয় ও রাজশাহী সার্কেলের দায়িত্বে ছিলেন বাণিজ্যিক অডিট অধিদফতরের রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের নিরীক্ষা ও হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা সাইদুর রহমান। আর প্রধান কার্যালয়ের আওতাধীন রংপুর ও ঠাকুরগাঁও সার্কেলের দায়িত্বে ছিলেন অধিফতরের নিরীক্ষা ও হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অডিট টিম ২০১২-১৮ সালের হিসাব নিরীক্ষা করে। চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত নিরীক্ষা কার্যক্রম চালানো হয়। বাণিজ্যিক অডিট অধিদফতরের রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের এই দু’টি অডিট টিম অডিট করলেও তা নিয়েও আপত্তি উঠেছে। তবে নিরীক্ষাকালে কী পরিমাণ টাকার অডিট আপত্তি উঠে এসেছে সে সম্পর্কে সূত্রটি সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য জানাতে পারেনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র দাবি করেছে, দায়সারাভাবে এ অডিট করা হয়েছে। এ জন্য কাউকে কাউকে ন্যূনতম ৩০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পর্যন্ত গুনতে হয়েছে। যদিও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উৎকোচ নেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। অধিফতরের নিরীক্ষা ও হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান ও সাইদুর রহমান বলেন, এ ধরনের অভিযোগ সঠিক নয়।

শ্রমিক-কর্মচারীদের ৮ দফা দাবি না মানায় এবং এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় রেজিস্টার অব ট্রেড ইউনিয়ন্স বিভাগীয় শ্রম অধিদফতর রাজশাহীর পরিচালক বাদি হয়ে বিএমডিএ’র ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক আবদুর রশিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করেছেন। রাজশাহী শ্রম আদালতে বর্তমানে মামলাটি বিচারাধীন। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হুমকি-ধমকি দেয়া, হয়রানি, খারাপ আচরণ করাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে যোগাযোগ করা হলে বিএমডিএ’র ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক আবদুর রশিদ বলেন, কাজ করতে গেলে অনিয়ম, অডিট আপত্তি উঠবে। আবার সেসব নিষ্পত্তিও হবে। তবে কোনো অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবি করেন তিনি।

জানতে চাইলে বিএমডিএ’র হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) রোকনুজ্জামান বিশ্বাস বলেন, দুর্নীতি-অনিয়মের বিষয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না।

বিএমডিএ’র অডিট অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) বাসুদেব চন্দ্র মহন্ত বলেন, অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ সঠিক নয়। অডিট টিমকে কোনো উৎকোচ দেয়া হয়নি। আমরাও কোনো উৎকোচ নেয়নি।(সূত্র: নয়া দিগন্ত)।

স্ব.বা/শা

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *