রাবির প্রথম প্রশাসনিক ভবন হবে জাদুঘর

রাজশাহী লীড

স্টাফ রিপোর্টার: পদ্মার কোলঘেঁষে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রশাসনিক ভবন ও সংরক্ষিত পুরাকীর্তি বড়কুঠি। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারক প্রাচীন এই ইমারতের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে গড়ে ওঠা বড়কুঠির প্রাচীরে শ্যাওলা জন্মেছে। খসে পড়ছে দেয়ালের পলেস্তারা। দরজা, জানালা ও কাঠের সিঁড়িতে ঘুণ ধরেছে। একইসঙ্গে রয়েছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব।

তবে বড়কুঠি আংশিক সংস্কার ও সংরক্ষণের মাধ্যমে জাদুঘর নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর। এ উদ্দেশে তাদের সাত সদস্যের একটি দল মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) সকালে রাজশাহী এসেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) একজন প্রকৌশলীকে সঙ্গে নিয়ে ভবনটির ছবি ও নকশাসহ মাপজোক করেছেন তারা।

বগুড়ার আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানা বলেন, ‘এখনও রাবি কর্তৃপক্ষ এই ভবন হস্তান্তর করেনি। তবে মন্ত্রণালয় থেকে গেজেট প্রকাশের পর সংস্কার ও সংরক্ষণের জন্য চলতি অর্থবছরে একটি প্রকল্প তৈরি করা হবে। ভবনটির গুরুত্ব অপরিসীম। তাই এটি সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রয়োজন। একইসঙ্গে এই ভবনে একটি জাদুঘর করলে পদ্মাপাড়ে বেড়াতে আসা ভ্রমণপিপাসুরা ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার সুযোগ পাব্নে। তাই আমরা এটিকে তালাবদ্ধ করে রাখতে চাই না। তবে এসব বাস্তবায়ন করা দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার।’

বড়কুঠি ভবনএদিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তিকে কমিউনিটি সেন্টার বানিয়ে বিয়ে ও নৈশভোজ পার্টির আয়োজন করা হচ্ছে। বড়কুঠির ভেতরে প্রথমে কিছুটা চুপিসারে হলেও সম্প্রতি রীতিমতো বিয়ের তোরণ ও বর-কনের মঞ্চ সাজিয়ে চেয়ার-টেবিল পেতে ঢাকঢোল পিটিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছে।

অথচ এসব বিষয় নাকি জানা নেই প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর বা রাবি কর্তৃপক্ষের! এ প্রসঙ্গে নাহিদ সুলতানা বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কেউ আমাদের বিষয়টি অবহিত করেনি কিংবা অনুমতি নেয়নি। আমাদের অগোচরে এ ধরনের অনুষ্ঠান হয়েছে। তবে এখন থেকে কেউ আর এমন সুযোগ পাবে না।’

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঁচজন নিরাপত্তা প্রহরী পালাক্রমে বড়কুঠি ভবনে দায়িত্ব পালন করেন। তাদেরই একজন মোসলেম উদ্দিন বলেন, ‘আমার সেদিন ডিউটি ছিল রাতে। আমি আসার আগেই বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেছে।’ অন্য নিরাপত্তা প্রহরী গোলাম মর্তুজা ও কেয়ারটেকার সিরাজুল ইসলাম বাবলুর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।বড়কুঠি ভবনের নাজুক অবস্থাঐতিহ্যবাহী ভবনটি বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহারের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ অনেকে।

রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, ‘বড়কুঠির গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। একইসঙ্গে এখানে বিয়েসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান বন্ধ করতে হবে। ভবনটি নিয়ে কেউ ছিনিমিনি খেললে আমাদের সংগঠন থেকে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।’

বড়কুঠিতে বিয়ের অনুষ্ঠান করার দায়ভার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপর বর্তায় উল্লেখ করে ভবনটি সংরক্ষণে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান প্রগতিশীল ছাত্রজোটের সাবেক আহ্বায়ক ও বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী সভাপতি ফিদেল মনির। তার মন্তব্য, ‘বড়কুঠির মতো ঐতিহ্যবাহী পুরাকীর্তিতে টাকার বিনিময়ে বিয়ের অনুষ্ঠান করতে দেওয়া দুঃখজনক। কারণ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত এই ভবন।’

বড়কুঠি ভবনকার অনুমতিতে বড়কুঠি ভাড়া দেওয়া হচ্ছে তা তদন্ত করে দেখার দাবি জানিয়েছে রাবি শিক্ষক সমিতি। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল আলম খান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কোনও ভবনে একটি অনুষ্ঠান করতে গেলে প্রশাসন থেকে অনুমতি নিতে হয়। অথচ ঐতিহ্যবাহী পুরাকীর্তি টাকার বিনিময়ে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানে না তা হতে পারে না।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য আনন্দ কুমার সাহা বলেন, ‘বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত।’ তবে এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

বড়কুঠি ভবন উইকিপিডিয়া ও মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে জানা গেছে, অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের কোনও এক সময় ব্যবসায়িক কাজে ডাচরা বড়কুঠি নির্মাণ করেন। দেশভাগের পর জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে সরকারি সম্পত্তিতে পরিণত হয় এটি। ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে বড়কুঠি সেখানে হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে এটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি।

বড়কুঠির বহির্ভাগের দৈর্ঘ্য ২৪ মিটার (৮২-০) ও প্রস্থ ১৭ দশমিক ৩৭ মিটার (৬৭-০)। দ্বিতল এই ইমারত বিভিন্ন আয়তনের মোট ১২টি কক্ষে বিভক্ত। দ্বিতলে একটি সভাকক্ষসহ ছয়টি কক্ষ আছে। কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত পূর্ব-পশ্চিমে ৯ দশমিক ৬০ মিটার এবং উত্তর-দক্ষিণে ৬ দশমিক ৩০ মিটার আয়তনের সভাকক্ষের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একটি করে বারান্দা রয়েছে। উত্তরের বারান্দা ৯ দশমিক ৬০ ও ৫ দশমিক ৮৫ মিটার এবং দক্ষিণের বারান্দা ৯ দশমিক ১৮ ও ৫ দশমিক ৮৫ মিটার। কক্ষের পশ্চিম দিকে দুটি ও পূর্ব দিকে একসারিতে তিনটি কক্ষ বিদ্যমান।

স্ব.বা/শা

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *