রাজশাহীর ইতিহাস-ঐতিহ্যের অন্যতম স্মারক সাহেব বাজার বড় মসজিদ

রাজশাহী লীড

স্টাফ রিপোর্টার: রাজশাহী মহানগরীর ইতিহাস-ঐতিহ্যের অন্যতম স্মারক হয়ে রয়েছে নগরীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত সাহেব বাজার বড় মসজিদ কমপ্লেক্স। প্রায় দু’শো বছর আগে এর ভিত্তি স্থাপিত হয়। বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে এটি এখন এক দৃষ্টিনন্দন শৈলিসম্পন্ন স্থাপত্য হিসেবে বিরাজমান।

সাহেব বাজার বড় মসজিদের সর্বপ্রাচীন অবকাঠামো নির্মাণের নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় না। গবেষকদের ধারণায় বলা যায়, অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে মসজিদটি নির্মিত হয়। উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে শহর হিন্দু প্রধান হয়ে ওঠার কারণে মসজিদটি যত্নের অভাবে পড়ে। অযত্নের কারণে একটি পর্যায়ে এসে মসজিদটি নিশ্চিহ্ন হবার উপক্রম হয়। এক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির প্রচেষ্টায় উনিশ’ দশ/বারো সালের দিকে এর অস্তিত্ত্ব অম্লান থাকে। পরবর্তীকালে কয়েকজন সমাজ সচেতন ব্যক্তির প্রচেষ্টায় মসজিদটির পূর্ব ঐতিহ্য ফিরে আসে। একটি মাত্র মেহরাব থেকে পুনরায় নির্মাণ সম্ভব হয় এর পূর্ণ অবয়ব।

সেসময় মসজিদটি মোগল প্যাটার্নে তৈরি হলেও আধুনিক কারুকার্যের ফলে উত্তর বাংলার প্রথম আধুনিক ডিজাইনের মসজিদ হিসেবে পরিচিত পায়। ১৯২৭ সালে মসজিদটির দ্বিতীয় বার ভিত্তি স্থাপিত হয় এবং পূর্ণ আকৃতি পায় ১৯৫৪ সালে। এর নির্মাণে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাক্তন কোষাধ্যক্ষ আব্দুল হাকিম কোরায়েশী ও আমির আলী প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। এ জন্য তাঁদের প্রচুর ত্যাগ স্বীকার ও শ্রম দিতে হয়। তাঁরা ভারতের মধ্যপ্রদেশের কোন এক মসজিদের অনুকরণে এর ডিজাইন তৈরি করেছিলেন।

মসজিদটির প্রাচীনত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন জনশ্রুতির প্রচলন আছে। অনেকে ১৯২১ সালের পূর্বে সেখানে একটি প্রাচীন তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের দাবি করেন। কিন্তু সেখানে একটি মেহরাব ছাড়া অন্য কোন চিহ্ন অবশিষ্ট ছিলো না। ১৯২১ সালে জনৈক সদাই ফকিরের শিষ্য খোঁয়াজ আহমদ উক্ত মেহরাবকে কেন্দ্র করে মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নিলে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়, জেলা বোর্ড ও মিউনিসিপ্যালিটি কর্তৃপক্ষ এতে বাধা দেয়। এজন্য খোয়াজ আহমদ এমনকি দু’মাস জেলও খাটেন।

অবশেষে ১৯২৩ সালে রাজশাহী সদর মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট সরেজমিন তদন্ত করে মসজিদ নির্মাণের পক্ষে রায় দেন। রাজশাহী কালেক্টরের মহাফেজখানায় (রেকর্ড রুম) রক্ষিত ১৮৪৯ সালের একটি সার্ভে নকশায় এখানে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের নকশা আছে। এর দাগ নং ১৫১।১৬শ’ গজের ৮ বিঘা জমির উপর এর চৌহদ্দী নির্দিষ্ট ছিলো। প্রাচীন পত্রিকা হিন্দু রঞ্জিকা পত্রিকায় এ মসজিদের উল্লেখ পাওয়া যায়। একবিংশ শতাব্দীতে এসে তৃতীয় বার নির্মিত হয়েছে সাহেব বাজার বড় মসজিদ।

রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগ ও গৃহীত প্রকল্পের মাধ্যমে মসজিদটি পুনরায় নির্মাণের জন্য সড়ক ও জনপথকে মসজিদের সামনের রাস্তাটি ছেড়ে দিতে হয়। তবে রাস্তাটি সচল রেখেই মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদ কমপ্লেক্স এমন প্যাটার্নে নির্মাণ হয়েছে যাতে রাস্তাও আছে, আবার তার ওপর ভবনও দাঁড়িয়ে আছে। এ জন্য ৭.৯২ শতক জায়গা ছেড়ে নির্মাণ করা হয় ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোর।

রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মিজানুর রহমান মিনু ২০০২ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর তৃতীয় পর্যায়ে আধুনিক স্থাপত্যশৈলিতে এই মসজিদের নতুন ভবন নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন যা ছিল নগরবাসীর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা। এটি মেয়র মিনুর অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও ছিল। ২০০৪ সালের ১২ নভেম্বর শুক্রবার নতুন কমপ্লেক্সের ভিত্তি স্থাপন করেন তিনি। তাঁর সময়ে প্রায় ৩ কোটি টাকার গৃহীত প্রকল্পে ৪ তলা ভিত্তির উপর তিন তলা পর্যন্ত নির্মিত হয়। বাইরের অংশসহ আরো কিছু কাজ অসমাপ্ত থাকে।

২০০৮ সালে এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর অবশিষ্ট কাজ শেষের জন্য নতুন একটি প্রকল্প গৃহীত হয়। ২০১১-১২ অর্থ বছর থেকে বাস্তবায়ন শুরু হয়। ১৫ দশমিক ৬০ শতক জায়গার উপর পুননির্মিত এ মসজিদে ৪টি ফ্লোরে একসঙ্গে প্রায় ৩ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদ ভবনের উত্তর ও দক্ষিণে আছে দুটি সিঁড়ি। আছে ৪টি ওজুখানা, ১টি গ্রন্থাগার, ইমাম ও মুয়াজ্জিনের থাকার ব্যবস্থা। মসজিদের ছাদে নির্মাণ করা হয়েছে ৪টি গম্বুজ ও ১টি মিনার। মসজিদের গ্রাউন্ড ফ্লোরের আয়তন ২ হাজার ৫০০ বর্গফুট। ২য়, ৩য় ও ৪র্থ প্রতি ফ্লোরের আয়তন ৪ হাজার ৫০০ বর্গফুট। মসজিদের প্রধান দরজার দু’পাশে ও পশ্চিম পাশে বা পিছনে দোকান নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে।

সাহেব বাজার বড় মসজিদ কমপ্লেক্স নিমার্ণের ফলে রাজশাহীর একটি ঐতিহ্যবাহী ইসলামী সংস্কৃতির পীঠস্থান হিসেবে এটি চিহ্নিত হয়। শুধু নামাজ পড়া নয়- ইসলামী শিক্ষা, মূল্যবোধ ও সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশে এর অবস্থান অনস্বীকার্য।সূত্র: দৈ: সংগ্রাম।

স্ব.বা/শা

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *