বিয়ের আনন্দে বিষাদের কান্না, কাঁধে ছেলে-স্ত্রীর লাশ

বিশেষ সংবাদ রাজশাহী লীড

আব্দুল হামিদ মিঞা,বাঘা:
বিয়ের পুরোদস্তর প্রস্তুতি নিচ্ছিল উপজেলার সরেরহাট গ্রামের মেয়ে,রাজশাহী কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স পাশ মাহবুবা আকতার জেসমিন। বিয়ের পিঁড়িতে বসার দিনক্ষণ ঠিক। দুই পরিবারে যেন আনন্দের বন্যা বইছিল। আগামী শুক্রবার (২৭-১২-১৯) সারাদিন ছিল সেই বিয়ের অনুষ্ঠান। কথামতো মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পরিবারের সকলের বাড়ি ফেরার কথা থাকলেও তাদের কারো দেহে ছিল না প্রাণপাখি। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে মাহবুবা আকতার জেসমিনের বিয়ের অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু মাহবুবা আকতার জেসমিনের একার নয়,পুরো পরিবার জুড়ে নেমে আসে শোকের মাতম। সড়ক দুর্ঘটনাই তার সব কেড়ে নিয়েছে। বিয়ের ২ দিন আগে শেষ বিদায় জানাতে হয়েছে,মা,ভাই,ভাবি ও তার ৭ মাসের ভাতিজাকে। বিয়ে বাড়িতে এখন চলছে শোকের মাতম। একই সাথে মারা গেছে গ্রামের আরেকজন।

মঙ্গলবার (২৪-১২-১৯) দুপুরে ভাড়া করা জালাল উদ্দীনের সিএনজিতে ঝিনাইদহ সদর জেলার ভগবানপুর গ্রামের শ্বশুর বাড়ি থেকে স্ত্রী রুনা খাতুন (২৬), ৭ মাসের শিশু ছেলে ইব্রাহীম হোসেন রোজদি ও মা মাহমুদা বেগমকে নিয়ে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার নিজ গ্রাম সরেরহাট আসছিলেন, বেরসরকারি সংস্থায় কমর্রত মেজবাউল আলম মাসুম। ছোট বোনের বিয়ের জন্য ছুটিতে এসে মঙ্গলবার সকালে সিএনজিতে মাকে নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে দাওয়াত দিতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে স্ত্রী,শিশু ছেলে ও মাকে নিয়ে আবার সিএনজিতে করে বাড়িতে ফিরছিলেন। বিয়ের আনন্দে মাতবেন এমনটা আশা ছিল সবার মনে।
কিন্তু গ্রামের বাড়িতে ফেরার পথে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলায় লালন শাহ সেতু সংলগ্ন এলাকায় ট্রাকের ধাক্কায় সিএনজিটি দুমড়ে-মুচড়ে গিয়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন, মেজবাউল আলম মাসুমের স্ত্রী রুনা খাতুন (২৬), ৭ মাসের শিশু ছেলে ইব্রাহীম হোসেন রোজদি ও সিএনজির চালক জালাল উদ্দীন। ভেড়ামারা ফায়ার সার্ভিসের টিম লিডার হাসানুজ্জামান জানান, গুরুতর আহত মেজবাউল আলম মাসুম ও তার মা মাহমুদা বেগমকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তারা (মা ও ছেলে) । মঙ্গলবার (২৪-১২-১৯) দুপুরের পর ভেড়ামারা-পাবনা মহাসড়কের ৪১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র সংলগ্ন যাত্রী ছাউনি এলাকায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। ময়না তদন্তের পর তাদের মরদেহ মঙ্গলবার রাত পৌণে ১২ টায় নিজ বােিড় পৌঁছে। অনেক স্বজন তাদের এক নজর দেখার জন্য ছুটে আসেন। নিহতের সকলের বাড়ি বাঘা উপজেলার সরেরহাট গ্রামে।

বুধবার (২৫-১২-১৯) সকালে মাহবুবা আকতার জেসমিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়,সেখানে কোনো ধুমধাম নেই। চলছে স্বজনদের আহাজারি। শত শত লোকের ভিড় বাড়িতে। সবার মুখেই শোকের ছায়া। স্বজনরা একে অপরকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছিল। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন মেজবাউল আলম মাসুমের বাবা সরেরহাট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের মাওলানা শিক্ষক সোলেমান হোসেন ও তার দুই বোন মাহবুবা আকতার জেসমিন ও বিবাহিত আরেক বোন জান্নাতুল। বুক চাপড়ে বলছিলেন, সব গেলগারে। ‘আশার সব শেষ। আমরা কী নিয়া বাঁচবো। ১ ছেলে, দুই মেয়ে আর নাতি-নাতনিদের নিয়ে সুখেই ছিলেন শিক্ষক সোলেমান হোসেন। নাতি-নাতনিরা পড়ালেখা করে মানুষ হবে। ওদের বিয়েশাদি হবে। আর চেয়ে চেয়ে দেখবেন এটাই আশা ছিল। কিন্তু এক মেয়ের বিয়ের দাওয়াত দিয়ে ফিরতে গিয়ে সবই চলে গেল। শেষবারের মতো আদরের নাতিকেও একটু ধরে দেখতে পারলেন না। সিএনজি চালক জালাল উদ্দীনের বাড়িতেও চলছিল শোকের মাতম। বাড়ির উঠানে বসে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করছিলেন স্ত্রী রুনা লাইলা ও মা সানোয়ারা। স্ত্রী বলছিলেন,একমাত্র ছেলে রান্টুকে রেখে ‘স্বামী চলে গেল। বাবা ছবির গাইন নাতিকে জড়িয়ে বলছিলেন কার ওপর দোষ দেব?’ সেখানে দেখা গেলে পুরো পরিবারই মৃত্যুর যন্ত্রণায় কাতরাছে।

বুধবার সকাল ১১ টায় দাদপুর-গড়গড়ি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নিহত ৩জনের একসঙ্গে জানাযা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। মাওলানা শিক্ষক সোলেমান হোসেন স্ত্রী ও ছেলেসহ চালক জালাল উদ্দীনের জানাযা নামাজে ইমামতি করেন। উপস্থিত ছিলেন,বাঘা উপজেলা চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট লায়েব উদ্দীন লাভলু, বাঘা উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহিন রেজা ,চারঘাট উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আবু সাইদ চাঁদ,গড়গড়ি ইউপিচেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম সহ জনপ্রতিনিধি,রাজনৈতিক,সামাজিক সংগঠন, শিক্ষকসহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষ। তাদের দাফন করা হয় এলাকার গোরস্থানে। অপর দুইজনকে দায়ন করা হয়েছে ঝিনাইদহ সদর জেলার ভগবানপুর তাদের নিজ গ্রামে । উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহিন রেজা বলেন,ওই পরিবারগুলোর পাশে উপজেলা প্রশাসন সার্বক্ষণিক থাকবে।

স্ব.বা/বা

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *